কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় মো. রোকনুজ্জামান রোকন (৪০) নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে এক প্রধান শিক্ষককে তুলে নিয়ে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা রােকনুজ্জামান রােকন, সহযোগী আসাদুজ্জামান ও অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই আওয়ামী লীগ নেতা রৌমারী উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রৌমারী সিজি জামান উচ্চবিদ্যালয়ে মারধরের এ ঘটনা ঘটে। আজ শনিবার বিকেলে এ ঘটনায় মামলা করেছেন মারধরের শিকার ওই শিক্ষক মো. নুরুন্নবী (৪১)।
মামলার বাদী নুরুন্নবী উপজেলার চর শৈলমারী ইউনিয়নের ফুলকার চর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অভিযুক্ত রোকনুজ্জামান উপজেলা আওয়ামী লীগের সদ্য ঘোষিত কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। এ ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বিষয়টি জানাজানি হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দেন নুরুন্নবী। লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে নুরুন্নবী ও বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুর রশীদ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ে যান। এ সময় রোকনুজ্জামানের লোকজন নুরুন্নবী ও রশীদকে সেখান থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে রোকনুজ্জামানের মালিকানাধীন পলি এন্টারপ্রাইজের বাস কাউন্টারে নিয়ে আটকে রাখেন।
সেখানে নুরুন্নবীকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। তবে অফিস সহকারী রশীদ সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে রৌমারী সিজি জামান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু হোরায়রাকে বিষয়টি জানান। আবু হোরায়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
খবর পেয়ে রোকনুজ্জামানকে কল দিয়ে আবু হোরায়রা বলেন, নুরুন্নবীকে সঙ্গে নিয়ে তার কার্যালয়ে আসতে। কিছু সময় পর নুরুন্নবীকে সঙ্গে নিয়ে রোকনুজ্জামান ও তাঁর সঙ্গী মো. আসাদুল ইসলাম (৪৭) সিজি জামান উচ্চবিদ্যালয়ে যান।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হোরায়রার উপস্থিতিতে কথাবার্তা চলছিল। এর একপর্যায়ে রোকনুজ্জামান ও তার লোকজন নুরুন্নবী ও অফিস সহকারী রশীদকে মারধর শুরু করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন নুরুন্নবী ও রশীদকে মারধর থেকে রক্ষা করেন।
খবর পেয়ে রৌমারী থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নুরুন্নবী ও রশীদকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানেই নুরুন্নবী বাদী হয়ে রোকনুজ্জামান ও আসাদুল ইসলামের নামে থানায় লিখিত অভিযোগ দেন।
নুরুন্নবী বলেন, বিদ্যালয়ের নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে রোকনুজ্জামান ও আসাদুলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে রৌমারী সিজি জামান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে সেখানে রোকনুজ্জামান ও আসাদুলের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রোকনুজ্জামান ও আসাদুল চড়াও হয়ে তাঁকে কিল–ঘুষি মেরেছেন।
নুরুন্নবী বলেন, ‘বিদ্যালয়ের নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি (রোকনুজ্জামান) ঝামেলা করেন। তাঁর পছন্দের লোককে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করতে তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আজ রোকনুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ওই নম্বরে এসএমএস পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
আবু হোরায়রা বলেন, ‘ওই দিন রোকনুজ্জামান উত্তেজিত হয়ে নুরুন্নবীকে কিল–ঘুষি মারতে শুরু করেন। আমি ও উপস্থিত শিক্ষকেরা মিলে নুরুন্নবীকে রোকনুজ্জামানের আক্রমণ থেকে উদ্ধার করে পুলিশি হেফাজতে দিয়েছি। মূলত ফুলকার চর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। আমি পরে বিষয়টি জেনেছি।’
রোকনুজ্জামানের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে আবু হোরায়রা বলেন, ‘রাগের মাথায় প্রধান শিক্ষককে পেটানোর বিষয়টি নিয়ে রোকনুজ্জামান আমার কাছে মৌখিক ক্ষমা চেয়েছেন। আমি এ ঘটনার বিষয়ে রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে জানিয়েছি। তিনি ঢাকায় আছেন। রৌমারীতে ফিরে এলে দলীয় বৈঠক করে রোকনুজ্জামানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রোকনুজ্জামান যে কাজ করেছেন, সেটা বড় ধরনের অন্যায়। তাই একক সিদ্ধান্ত নয়, রোকনুজ্জামানের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুপ কুমার সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার প্রধান শিক্ষক নুরুন্নবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। পুলিশ তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। লিখিত অভিযোগটি আজ মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
এবার প্রশ্ন বাংলাদেশে শিক্ষক নির্যাতনের এই ধারা কি সাম্প্রতিক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানান, ‘‘এখন শিক্ষার দাম নেই, তাই শিক্ষকদেরও দাম নেই৷ এখন অর্থ আর ক্ষমতাবানদের সময়৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমনই হয়৷ এটা একদিনে হয়নি৷ আমাদের অবক্ষয় ক্রমেই নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷”
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, গত ১০ বছরে শিক্ষকদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে৷ বেশি নির্যাতিত হয়েছেন সংখ্যালঘু শিক্ষকরা৷ দীর্ঘদিন শিক্ষা বিষয়ে কাজ করেছেন সাংবাদিক শরিফুজ্জামান পিন্টু৷ তিনি বলেন, ‘‘আগেও শিক্ষক নির্যাতন ছিল, কিন্তু সেটা এখনকার মতো না৷ খুব অল্প সময়ে শিক্ষকদের নির্যাতনের নতুন মাত্রা পেয়েছে৷ সামাজিক অবক্ষয় এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷’’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘শিক্ষকদের এই আক্রান্ত হওয়ার জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী৷ রাষ্ট্রের যেমন দায় আছে, আমাদেরও দায় আছে৷ আমরা শিক্ষকদের সম্মান দিচ্ছি না, যেটা নতুন প্রজন্ম দেখছে৷ তারাও সেটা শিখছে৷ আগে রাষ্ট্রকে শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে৷ তাহলে এই ধরনের নির্যাতন দিন দিন কমে আসবে৷ আবার যারা নির্যাতন করছেন তারাও ক্ষমতাধর হওয়ায় কোনো বিচার হচ্ছে না৷ ফলে নির্যাতনের পরিমানটা বেড়েই চলেছে৷
আপনার মতামত জানানঃ