গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতুর চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর দিন থেকে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সেতু চালুর পর এ পর্যন্ত সরকার টোল বাবদ ৪০০ কোটি টাকার কিছু বেশি আয় করেছে।
সূত্র মতে, সেতুটি দিয়ে ২০১৪ সাল থেকে পরবর্তী ৩৫ বছরে প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে, তার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এতে টোল বাবদ বছরে কত আয় হতে পারে, এরও ধারণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেতু চালু হয়েছে আট বছর পর, ২০২২ সালে। পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২২ সালে প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করার কথা। ২০২৯ সালে তা হবে দৈনিক ৩৪ হাজার ৭২৫। ২০৫০ সালে এই সেতু দিয়ে দৈনিক যানবাহন চলাচল করবে ৬৬ হাজার ৮২৯টি।
২০২২ সালে সেতু থেকে টোল বাবদ ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা আয় করার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ২০২৯ সালে আয় হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। আর ২০৫০ সালে এই সেতু থেকে ৩ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা আয় হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাভাসের চেয়ে আয় কম
সেতু বিভাগের হিসাবে, চালুর পর পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৪ হাজার ৭১৮টি করে যানবাহন পারাপার হয়েছে। ছয় মাসে টোল থেকে আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার মতো। প্রতিদিন গড়ে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি সাড়ে ১২ লাখ টাকার মতো করে। সে হিসাবে বছর শেষে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার টোল আদায় হতে পারে।
অর্থাৎ পূর্বাভাসের চেয়ে প্রতিদিন ৯ হাজারের মতো যানবাহন কম চলেছে। বছর শেষে আয়ও পূর্বাভাসের চেয়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো কম।
সেতু বিভাগের সূত্র বলছে, দৈনিক যানবাহন চলাচলের সংখ্যা পূর্বাভাস থেকে বেশি হওয়ার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চলাচল করার সুযোগ দিতে হবে। যেমন, চালুর প্রথম দিন ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন চলাচল করেছে। ওই দিন টোল আদায় হয় দুই কোটি ৯ লাখ টাকা।
সরকার দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সেতু চালুর দুদিন পরই মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের পরদিন যানবাহন চলাচল দাঁড়ায় ২৩ হাজারের কম। এরপর প্রতিদিনই যানবাহন চলাচলের হার কমেছে। তবে যানবাহন চলাচল কমলেও টোল আদায়ের হার কমেনি।
সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, মোটরসাইকেল চলতে দিলে দিনে অন্তত ১০ হাজার যানবাহন বেড়ে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে আয় বাড়বে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু মোটরসাইকেল বন্ধের পর বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন বেড়েছে। এসব যানের টোল হার বেশি।
কম আয় বনাম ঋণের চাপ
পদ্মা সেতুর পূর্বাভাস মতো আয় না হলে কী সমস্যা? এই প্রশ্ন আসতেই পারে। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেও এই টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে। এটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। নিজের আয়ে চলতে হয়। পদ্মা সেতুর মতো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তারপুর সেতু এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলও এই প্রতিষ্ঠানের অধীন।
বঙ্গবন্ধু সেতু বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণে নির্মিত হয়েছে। সেতুর টোল থেকে এই ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০৩৪ সাল থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। একইভাবে টানেল নির্মাণের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে চীনকে। পদ্মা সেতুর ঋণের টাকা কখন, কীভাবে পরিশোধ করতে হবে, এই বিষয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিও আছে সেতু কর্তৃপক্ষের।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় যে টাকা বিনিয়োগ করেছে, এর বেশির ভাগই চীনা ঠিকাদারকে ডলারে রূপান্তরিত করে বিল দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সরকার টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে বিনিয়োগ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় অবশ্য সেতু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকাই নেবে। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালে সেতু বিভাগের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চুক্তি সই হয়েছে।
তখন অবশ্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। ফলে এই চুক্তিতে কিছুটা সংশোধন আনতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে, ৩৫ বছরে ঋণের টাকা ১ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হবে।
এ জন্য তিন মাস পরপর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৪০ কিস্তিতে ঋণের টাকা (সুদ ও আসলে) পরিশোধ করা হবে। কোন বছর কত টাকা ফেরত দিতে হবে, এর একটা রূপরেখাও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। সেতু চালুর পর প্রথম বছরের কিস্তি ৫৯৬ কোটি টাকা। দশম বছরে গিয়ে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ১৬তম বছরে গিয়ে কিস্তির পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ৩৫ তম বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ