CRISPR নামক এক নতুন প্রযুক্তি সাম্প্রতিক বায়ো-টেকনোলজিতে এক মহান বিপ্লব এনে দিয়েছে। যেটি খুবই সাশ্রয়ী, কার্যকরী এবং সুনির্দিষ্টভাবে DNA কাট করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। একটা সময় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছিলো অত্যন্ত ধীর এবং অসম্পূর্ণ। জিন থেরাপির মাধ্যমে ভালো জিন ভাইরাসের মধ্যে সংক্রমণ করা হতো (যেটিকে নিউট্রালাইজ করা হত যেনো ক্ষতি না করতে পারে)। তারপর এই ভাইরাস পেশেন্টের শরীরে প্রবেশ করানো হতো, যা খুব দ্রুত পেশেন্টের সেলকে আক্রমণ করতো এবং ডিএনএ সংক্রমিত করতো।
এর উদ্দেশ্য ছিলো ক্রোমোজোমের সঠিক প্লেসে ডিএনএ ইনসার্ট করা। যাতে করে ডিফেক্টিভ কোড গুড জিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে। একটি ডিএনএ তে সামান্য পরিমাণ মিসপেলিং এর কারণেও বিভিন্ন রোগ দেখা দিত যার মধ্যে ছিল সিকেল সেল এনিমিয়া, Tay-Sachs এবং Cystic Fibrosis । স্বপ্ন ছিলো এটি সংশোধিত হবে।
কিন্তু ফলাফল ছিলো খুবই হতাশাজনক। কারণ প্রায়শ শরীর ভাইরাসকে শত্রু মনে করে এবং তার বিপক্ষে পালটা আক্রমণ করে বসে যার ছিলো ক্ষতিকর পার্শপ্রতিক্রিয়া। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো জিন সঠিক স্থানে বসানোই যেতোনা। এ ধরণের মারাত্মক কিছু বিপর্যয় ঘটার কারণে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলিভানিয়া ১৯৯৯ সালে অসংখ্য জিন থেরাপি এক্সপেরিমেন্ট সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
CRISPR টেকনোলজি এ ধরণের অনেক জটিলতাই দূর করে দেয়। আসলে এ প্রযুক্তির মূল ভিত্তি গঠিত হয় বহু বিলিয়ন বছর পূর্বেই। বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হন এটা দেখে যে, ব্যাক্টেরিয়া মরণঘাতী ভাইরাস সনাক্ত করতে পারে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ম্যাকানিজমে ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য। কিন্তু কীভাবে ব্যাক্টেরিয়া ডেডলি ভাইরাস সনাক্ত করতে পারে এবং তাকে নিরস্ত্র করতে জানে। তারা আবিষ্কার করলেন যে, ব্যাক্টেরিয়া থ্রেট সনাক্ত করতে পারে কারণ তারা ভাইরাসটির জেনেটিক্যাল ম্যাটারিয়ালের টুকিটাকি ধারণ করে।
অন্য কথায় ব্যাক্টেরিয়ার কাছে ভাইরাসটির জেনেটিক্যাল ম্যাটারিয়ালসের ডেটা আছে। মুখের ফটোর মতোই, ব্যাক্টেরিয়া এটি ব্যবহার করতে পারে কোনো আক্রমণকারী ভাইরাসকে সনাক্ত করার জন্য। একবার যখন ব্যাক্টেরিয়া জেনেটিক স্ট্রিং সনাক্ত করতে পারে বা ভাইরাসকে, এটি ভাইরাসটির অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট একটি স্থানে কেটে দেয় এবং একে নিউট্রালাইজ করে এবং এই পদ্ধতিতে তার ইনফেকশন নষ্ট করে দেয় যখন টার্গেট DNA পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা একই প্রসেসটি রেপ্লিকেট করতে সক্ষম হয়েছেন। ভাইরাল সিকোয়েন্সকে সফলতার সাথ অন্য ধরণের ডিএনএর মধ্যে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে এবং সে ডিএনএ কোনো টার্গেট সেলে ইনসার্ট করার মাধ্যমে। আর এভাবে “জিনোম সার্জারী” সম্ভবপর হয়ে উঠে। CRISPR খুব দ্রুত এ প্রাচীণ পদ্ধতিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করেছে। যার ফলে এখন তারা আরো ক্লিয়ারলি, আরো যথাযথ ও দ্রুত গতিতে জিন এডিটিং করতে পারে।
Cas9 নামক একটি এনজাইম যা CRISPR system প্রডিউস করে সেটি ডিএনএ’কে বাইন্ড করে ও কেটে দেয়। আর এভাবে টার্গেটেড ডিএনএ অফ হয়ে যায়। Cas9 এর মোডিফায়েড ভার্সন ব্যবহার করে গবেষকরা ডিএনএ কাট করার পরিবর্তে জিন এক্সপ্রেসন একটিভেটও করতে পারে।
বায়ো-টেকনোলজিতে এ বিপ্লব ঝড় তোলে। এটি সম্পূর্ণ ভাবে পুরো ক্ষেত্রটাই বদলে দেয়। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ওয়েইস বলেন, এ সবকিছু ঘটেছে মাত্র এক বছরের মধ্যেই। এরপর ন্যাদারল্যান্ডের Hubrecht Institute সফলতার সাথে Cysrtix Fibrosis জিনোমিক এরর দূর করতে সক্ষম হয়। আশা জাগে, অনেক জেনেটিক রোগ এর মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হবে। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, ক্যান্সারের সাথে সম্পৃক্ত জিন এ পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করা যাবে এবং টিউমারের গ্রোথ প্রতিরোধ করা যাবে।
এ গবেষণা অনেকে খারাপভাবেও ব্যবহার করতে পারে। বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন যে এই প্রযুক্তি হয়তো জার্মলাইন জিন থেরাপিরও নেতৃত্ব দেবে। (দুই ধরণের জিন থেরাপি রয়েছে, সোমাটিক সেল জিন থেরাপি, যেখানে নন-সেক্স সেল মোডিফায়েড হয় আর এর ফলে মিউটেশন পরবর্তী প্রজন্মে যেতে পারেনা আর অন্য এক ধরণের জিন থেরাপিতে আপনার সেক্স সেল অল্টার হবে এজন্য আপনার উত্তরসূরীরা এ মোডিফায়েড জিন জন্মসূত্রে পাবে)।
জার্মলাইন জিন থেরাপিকে যদি প্রতিরোধ না করা হয় তবে এটি মানব প্রজাতির জেনেটিক ইনহেরিটেজ অল্টার করে দেবে। মিচিও কাকু বলেন, একদা আমরা যখন ভিন্ন কোনো নক্ষত্র ভ্রমণে বের হবো তখন হয়তো আমরা হবো সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম এক মানব প্রজাতি। কিন্ত এ জন্য অন্তত দশ হাজার বছর লাগবে। যদি জার্ম লাইন থিয়োরি রিয়েলিটি পায় তবে মাত্র একটি সিঙ্গেল জেনারেশনের ভেতরেই এটি অর্জন করা পসিবল।
এখন প্রশ্ন কেনো আমরা পোস্ট হিউম্যান হবো? আমাদের মানুষ থাকলেই বা সমস্যা কী? কেনো আমাদের ভেতর এ পরিবর্তন আনতে হবে? তাদের জন্য জেনে রাখা ভালো যে আমাদের জিনের ইউনিকলি অল্প কিছু সংখ্যক জিনই মানুষ। শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের জিনগত তারতম্য ১.৫ শতাংশ। এই ১.৫ শতাংশ জিন ডিলিট করে দিলে আমরা আর মানুষ নই, আমরা শিম্পাঞ্জি হয়ে যাই! ইঁদুর ও নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের জিনগত তারতম্য মুছে গেলে আমরাও নিয়ান্ডারথাল অথবা ইঁদুর হয়ে যাই!
আর এটাও মনে রাখা উচিত যে, মানুষ হলো বিবর্তনের বাইপ্রোডাক্ট, বিবর্তন আমাদেরকে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করেছে, আমরা তার উদ্দেশ্যের ভেতর ছিলাম না। কাকু বলেন, আমাদের দেহ হলো র্যান্ডম ও এলোমেলো কিছু মিউটেশনের প্রভাব। ব্লাইন্ডওয়াচমেকার যদি আমাদের এলোমেলো বিক্ষিপ্ত মিউটেশন পুঞ্জিভূত করে তৈরি করে তবে কেনো আমরা সিস্টেমেটিক্যালি টেকনোলজির মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন তৈরি করবো না?
তাদের আল্টিমেট উদ্দেশ্য হলো “Post Human” তৈরি করা, নতুন এক প্রজাতি যারা হিউম্যানিটিকে অতিক্রম করতে পারবে। এ কনসেপ্ট অনেকের কাছেই খুঁতখুঁতে মনে হতে পারে। UCLA বায়োফিজিসিস্ট গ্রেগ স্টক বলেন, এটা ঠিক যে, মানুষ বহু হাজার বছর উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জেনেটিক্স চেঞ্জ করছে। মিচিও কাকুর সাথে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের কাছে আজ যা কিছু ন্যাচারাল মনে হচ্ছে সবকিছু সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর বাইপ্রোডাক্ট। আমাদের আধুনিক ডিনার টেবিল অসম্ভব ছিলো যদিনা আমাদের পূর্বসূরিরা সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জিনে হস্তক্ষেপ না করতো। আমরা আমাদের চারপাশে আজ যে সকল রঙ বেরঙের কুকুর দেখি সেগুলোর সবগুলোই ধূসর নেকড়েদের একটি স্বতন্ত্র প্রজাতির বৈচিত্র্যতা। মানুষ প্রাণী জগতের জিনকে অল্টার করেছে, কুকুরকে ব্যবহার করেছে শিকারের জন্য এবং প্রাণী ও উদ্ভিদকে খাওয়ার জন্য। আমরা যদি সমস্ত পৃথিবী থেকে এভাবে তাদের রিমুভ করে দেই তবে একবার ভেবে দেখুন আমাদের পৃথিবীর কি ভয়াবহ একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে।
আজ নির্দিষ্ট কিছু জেনেটিক্যাল ট্রেইট বিজ্ঞানীরা আলাদা করেছেন। মানুষকে আর আটকানো পসিবল না। আপনার প্রতিবেশীর সন্তান যদি জেনেটিক্যালি তার সন্তানের বুদ্ধি সম্প্রসারিত করে তবে সে আপনার সন্তানের সাথে প্রতিযোগিতা করবে। আপনার উপর প্রচণ্ড প্রেসার সৃষ্টি হবে, আপনার সন্তান যদি তাদের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকতে চায় তবে তার জিনও অল্টার করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক খেলায়, যেখানে পুরস্কার আকাশ ছোঁয়া সেখানে খেলোয়াড়দের আটকানো সম্ভব নয়। আমেরিকা যদি পারমাণবিক বোমা বানায় তবে রাশিয়াও পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে এটাই গেম থিয়োরির নিয়ম।
এসডব্লিউএসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ