১৯৫৪ সালের জুলাই মাসের একদিন। অন্যান্য দিনের মতোই ব্যস্ত জাপানের টোকিও এয়ারপোর্ট। ইওরোপ থেকে আসা একটা বিমান অবতরন করলো। যাত্রীরা ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যার যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে; এরইমধ্যে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো রুটিন কার্যকলাপে। এক যাত্রীকে নিয়ে অদ্ভুত ধরনের সমস্যায় পড়লো ইমিগ্রেশানের কর্মকর্তারা।
যাত্রীদের একজন শেতাঙ্গ ইউরোপিয়ান। এসেছে ইউরোপ থেকে। পাসপোর্টও দিয়েছে, আর সেটা নকলও মনে হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো, পাসপোর্ট ইস্যুকারী দেশ হচ্ছে ‘ট্যোরেড’! এমন কোন দেশের নাম কর্মকর্তারা কেউ ইহজীবনে কখনও শোনেনি। ফলে, যাত্রীকে একটা রুমে বসানো হলো আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। উর্ধতন কর্মকর্তারা এলেন। যাত্রীতো এই ঝামেলার কারনে মহাখাপ্পা! সে জানালো, এবারেরটা নিয়ে এই বছরে এটা তার তৃতীয়বার জাপানে আগমন। গত পাচ বছরে সে একাধিকবার এমন ভ্রমন করেছে, কিন্তু কখনও তাকে এমন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার কাছে ইওরোপের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা পাওয়া গেল। সমস্যা আরো জটিল আকার ধারন করলো তখন, যখন যে কোম্পানী ভিজিটে সে এসেছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলো। তারা জানালো, এমন কোন লোককে তারা কোম্পানী ভিজিটে আমন্ত্রণ জানায়নি। সে যেই কোম্পানীর হয়ে কাজ করে বলেছে, সেই কোম্পানীটি খুজেই পাওয়া গেল না। এমনকি যে হোটেলে ভদ্রলোক তার রিজার্ভেশান আছে বলে জানালো, তারাও ভদ্রলোককে শনাক্ত করতে পারলো না।
ভদ্রলোকের মাতৃভাষা ফ্রেন্চ, কিন্তু জাপানীসহ আরো কয়েকটা ভাষায় তার দখল রয়েছে। তাকে যখন একটা ম্যাপ দেয়া হলো তার দেশ কোথায় দেখানোর জন্য, তখন সে আক্ষরিক অর্থেই আশ্চর্য হয়ে গেল। কারন, ফ্রান্স আর স্পেনের মাঝে যেখানে সে তার দেশ দেখাচ্ছে, সেখানে ‘ট্যোরেড’ নামে কোন দেশ নেই। আছে এন্ডোরা। সে বার বার বলতে থাকলো, এটা কিভাবে সম্ভব? গত প্রায় এক হাজার বছর ধরে এই দেশটা আছে! এই ম্যাপ নিশ্চয়ই ভুল!
এহেন পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারা এয়ারপোর্ট-সংলগ্ন একটা বহুতল হোটেল ভবনের উপরের দিকে একটা রুম বরাদ্দ করলো তার জন্য। সেই রুমে কোন ব্যালকনি ছিল না। বাইরে দু’জন সার্বক্ষনিক গার্ড রাখা হলো। তার বিভিন্ন দেশের ভিসা-সম্বলিত পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স আর অন্যান্য কাগজ-পত্র রেখে দেয়া হলো আরো তদন্তের জন্য।
পরদিন দেখা গেল, সেই রুমে কেউ নেই। তার কাগজ-পত্র যেই ভল্টে রাখা হয়েছিল, সেখানে কোন কাগজ-পত্রও নেই। মানুষটাসহ সবকিছুই একদম উবে গিয়েছে কর্পুরের মতো।
আরেকটা ঘটনা বলি, ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রুটি চুরি করতে গিয়ে এক লোক ধরা পরে। এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নাই, চৌর্যবৃত্তি এই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পেশা! তবে, আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে জানিয়েছিল যে তার দেশের নাম ‘লিজবিয়া’।
এবার আরেকটা ঘটনা। ১৮৫১ সালে জার্মানীর ফ্র্যান্কফুর্ট আন ডের ওডেরে উদভ্রান্তের মতো এক লোককে পাওয়া গিয়েছিল। তার দাবী অনুযায়ী, সে এসেছে ‘লাক্সারিয়া’ নামের একটা দেশ থেকে, যেটা ‘সাক্রিয়া’ মহাদেশের অন্তর্ভূক্ত!
উপরের এই তিনটি ঘটনাই মনে করা হয় যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বা অল্টারনেট ডায়মেনশানের কারনে ঘটেছিল। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড, যাকে প্যারালাল ইউনিভার্সও বলা হয়ে থাকে; বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই একে এখন পর্যন্ত একটা হাইপোথিসিস হিসাবে দেখতেই পছন্দ করেন। তবে, এর উপস্থিতিতে বিশ্বাস করেন এমন বিজ্ঞানীও নেহায়েত কম নেই বর্তমানে।
জেনে নেওয়া যাক, প্যারালাল ইউনিভার্স কী! পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বমতে, আমাদের এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই সমান্তরাল কিছু মহাবিশ্ব রয়েছে, যেখানে সময় আমাদের উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, বিশ্বজগতের কোথাও ঠিক এমন একটি মহাবিশ্ব আছে, যেখানে হয়তো আমাদের মতোই মিল্কিওয়ে ছায়াপথ আছে, আছে নানা নীহারিকা। সেখানেও সৌরজগতের মাঝে পৃথিবী নামে নীলাভ একটি গ্রহ আছে, যে গ্রহে হয়তো এই মুহুর্তে আপনার মতো দেখতে কেউ একজন অসীম আগ্রহ নিয়ে প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্ব সম্পর্কে পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও একইরকমের কিছু সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে, যারা একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না। একেই সাধারণভাবে প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়ে থাকে।
প্যারালাল ইউনিভার্সের সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সম্ভবত কোয়ান্টাম ফিজিক্সে। যেহেতু কোয়ান্টাম ফিজিক্স যথেষ্ট দুর্বোধ্য রকমের গাণিতিক সম্ভাবনা-নির্ভর একটি ক্ষেত্র, তাই আমরা বোঝার সুবিধার্থে খুব ছোট একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবো। এই তত্ত্বটি জম্বি-ক্যাট থিউরি নামেও পরিচিত।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতে, ইলেকট্রন একই সময়ে ক্লক-ওয়াইজ ও এন্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরতে পারে। অর্থাৎ একটা মার্বেল, ক্রিকেট বল, ফুটবল থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্রগুলোও ঘোরার সময় নির্দিষ্ট এক দিক অনুসরণ করলেও সাধারণত ইলেকট্রন তা করে না। এটি একই সময়ে দুই দিকেই স্পিন করতে পারে।
এখন মনে করুন, একটি বদ্ধ রুমে একটি ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন রাখা আছে। ইলেকট্রনটি স্পিন ডিটেক্টর একটি যন্ত্রের সাথে যুক্ত করা, যার শেষ প্রান্তে একটি হাতুড়ি যুক্ত আছে, যে হাতুড়ির সামনে রাখা বিষাক্ত গ্যাসভর্তি একটি কাচের টেস্টটিউব। ইলেকট্রনটি যদি ক্লক-ওয়াইজ স্পিন করে, তাহলে ডিটেক্টর যন্ত্রটি তা ডিটেক্ট করতে পারবে এবং হাতুড়ির আঘাতে টেস্টটিউবটি ভেঙে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়বে ও বিড়ালটি মারা যাবে। ইলেকট্রনটি এন্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরলে ডিটেক্টরে কোনো সংকেত পৌঁছাবে না, সুতরাং হাতুড়ি নড়বে না, টেস্টটউবটি অক্ষত থাকবে, ফলে বিড়ালটিও বেঁচে থাকবে। এখন, এক্ষেত্রে ঠিক কোন ঘটনাটি ঘটবে?
উত্তরটি একইসাথে খুবই সহজ এবং গোলমেলে। যদি ইলেকট্রনটি ক্লক-ওয়াইজ ঘুরে থাকে, তার মানে রুমটিতে একটি মৃত বিড়াল পড়ে আছে। যদি এর উল্টোটা হয়, অর্থাৎ ইলেকট্রনটি এন্টি ক্লক-ওয়াইজ ঘুরে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে রুমটিতে একটি জীবিত বিড়াল আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু বলেছি ইলেকট্রনটি একই সময়ে দুই দিকেই ঘুরছে, সুতরাং তত্ত্বমতে ঐ রুমে এখন এমন একটি বিড়াল রয়েছে যা একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত! অর্থাৎ পরীক্ষণের ফলাফল অনুসারে ওই রুমটিতে এমন একটি বিড়াল রয়েছে, যা জীবিত না আবার মৃতও না! এ ধরনের সম্ভাবনার কারণে একে জম্বি-ক্যাট বলা হয়!
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের এই অদ্ভুত নিয়মের কারণে গাণিতিকভাবে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন একাধিক কিন্তু বিপরীত ঘটনা ঘটমান থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি রুমের ভেতর লক্ষ্য করেন, তাহলে কি তিনি একইসাথে জীবিত ও মৃত বিড়াল দেখতে পাবেন? উত্তর হচ্ছে, না! অর্থাৎ একই পরীক্ষণের জন্য আমরা ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক রাখলে প্রত্যেকে শুধুমাত্র একটি ফলাফলই দেখতে পাবেন।
একজন পরীক্ষক মৃত বিড়াল এবং একই সময়ে অন্য একজন পরীক্ষক ওই রুমটিতে জীবিত বিড়াল দেখতে পাবেন। এর মানে হচ্ছে, একই ঘটনা দুজন পর্যবেক্ষক দুভাবে দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু একে অন্যেরটা দেখতে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট ঘটনার সাপেক্ষে তারা ভিন্ন দুটি সময় প্রত্যক্ষ করছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ দুটি ভিন্ন সময়রেখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। ঠিক যেভাবে সমান্তরাল দুটি রেখা পাশাপাশি অবস্থানে চলতে শুরু করলেও অসীম দূরত্বেও তাদের কখনও দেখা হবে না। অর্থাৎ, দুটি ভিন্ন বা বিপরীত ঘটনা একই সময়ে একই স্থানে ঘটার গাণিতিক এই সম্ভাবনা আমাদের প্যারালাল ইউনিভার্সের দিকেই ইঙ্গিত প্রদান করে!
সবশেষে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ প্রশ্নের উত্তর! প্যারালাল ইউনিভার্সের সত্যিই ভ্রমণ করা সম্ভব কি না! উত্তর, তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। তবে তার জন্যে দুটি জিনিসের প্রয়োজন। এক, ভিন্ন মাত্রায় অধিগমনের সক্ষমতা অর্জন। দুই, ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে অতীত ভ্রমণের মাধ্যমে প্যারালাল ইউনিভার্সে যাত্রা।
তবে পদার্থবিজ্ঞান যেহেতু আজ অব্দি আমাদের এই দুটির কোনোটিরই কোনোরূপ বাস্তব সম্ভাবনা দেখাতে সক্ষম হয়নি, তাই ধরে নিচ্ছি, আপাতত আমাদের আর প্যারালাল ইউনিভার্স বা মাল্টিভার্সে ভ্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এসডব্লিউএসএস/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ