ক্যালেন্ডার যখন ছিল না, তখন দিনক্ষণ নির্ধারণ করা বেশ কঠিন একটা কাজ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মিশরীয় জ্যোতির্বিদরা একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে দিনকে ১২ ঘন্টা ও রাতকে ১২ ঘন্টা হিসেবে ভাগ করে ২৪ ঘন্টায় একটি পূর্ণ দিন ধার্য করতেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো একটি বিশেষ পানির ঘড়ি তৈরি করে তাঁর আশ্রমের ছেলেদের পাঠ দিতেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানুষ যেদিন বছর কীভাবে গুনতে হয় তা শিখলো, সেদিন চাঁদের হিসেবেই শুরু করেছিল বছর গোনার কাজ। সৌর গণনার ব্যাপারটা শুরু হয় আরো পরে। তবে তার মানে এই না যে সৌর ও চন্দ্রের সাপেক্ষে গণনার নিয়ম একই। সৌর গণনার সাথে ঋতুর যোগসদৃশ থাকলে, চাঁদের গণনার সাথে ঋতুর কোনো সম্পর্ক নেই।
সুমেরীয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম ক্যালেন্ডারের মতন এক বস্তু লক্ষ করা যায়৷ আগেকার দিনে মিশরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক দিয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। ধারণা করা হয়, এই সভ্যতাতেই পৃথিবীর প্রাচীনতম সৌর ক্যালেন্ডার আবিষ্কৃত হয়৷ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেন যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে মিশরীয়রা ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মূল কাঠামোটা আসলে সৌর বর্ষের উপর নির্ভরশীল। এর বর্তমান যেই কাঠামোটা আমরা দেখতে পাই, এখানে পৌঁছাতে সময় লেগেছে কয়েকশো বছর! সেই সাথে করা হয়েছে নানান পরিবর্তন ও পরিমার্জন।
তবে গ্রগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আগে ইতিহাস জুড়ে আছে রোমান ক্যালেন্ডার আর পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম এক বছর। চলুন এ বিষয়ে জানা যাক।
সালটি ছিল ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং এই দীর্ঘতম বছরটি বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার তৈরি করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব সেই ৪৬ সাল ছিল ৪৪৫ দিনের! প্রসঙ্গত রোমান ক্যালেন্ডার বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল। তবে এটি এতোটাই বিভ্রান্তিকর ছিল, বেশিরভাগই রোমান এই দিন তারিখের খবর খুব একটা রাখতো না।
রোমান ক্যালেন্ডারে ১২ মাসে ৩৫৫ দিন ছিল। রোমানরা জানত যে সৌর বছর ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা দীর্ঘ, তাই তাদের অধিবর্ষ (২ বছর পর অধিবর্ষ হতো তখন) কে সৌর বছরের সাথে মেলাতে অতিরিক্ত ২২/২৩ দিন যোগ করতো। ফলস্বরূপ, রোমান ক্যালেন্ডারো বছরের দিন সংখ্যা হতো ৩৫৫ দিন, ৩৭৭ বা ৩৭৮ দিন।
এর সঙ্গে নতুন এক বিভ্রান্তির সংযোগ করেন তখনকার রোমান পুরোহিত পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস। তিনি অধিবর্ষে আরেকটি নতুন সংযোজন করেন। যখন তার মিত্র দল শাসন করবে তখন তিনি অধিবর্ষ কে দীর্ঘ করে দেন, আর বিরোধীদল শাসনে আসলে তা ছোট করে দিতেন।
বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় এসে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন, যা সকল সাধারণ মানুষের জন্য যুতসই হবে।
৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তিনি একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে রোমে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদদের ডেকে পাঠান যা রোমান ক্যালেন্ডারকে প্রতিস্থাপন করবে যা ইতিমধ্যে সৌর বছরের চেয়ে ৮০ দিন পিছিয়ে ছিল। নতুন এই ক্যালেন্ডারে বছর করা হয় ৩৬৫ দিনে আর যেহেতু সৌরবছর ৩৬৫ দিনের সাথে ৬ ঘন্টা অতিরিক্ত থাকতো তাই ৪ বছর পর পর লীপ ইয়ার যোগ করেন।
জুলিয়াস সিজার চেয়েছিলেন বছরের শুরু হোক মার্চ মাস দিয়ে, জানুয়ারি মাস নয়। কারণ রোমান ক্যালেন্ডারের প্রথা ছিল মার্চ মাস দিয়ে শুরু হওয়ার। আর তাই তিনি সাম্যতা আনতে ৯০ দিন অতিরিক্ত যোগ করেন চলতি বছরের সাথে। যার ফলে সেই বছর হয়ে যায় ৪৪৫ দিনের! আর তাই রোমানরা এই বছরের নাম দেন ‘বিভ্রান্তির বছর’!
এরপর ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রবর্তন করেন নতুন এক বর্ষপঞ্জির। তিনি হিসাব করে বের করে দেখেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর ১১ মিনিটের গরমিল থাকায় ইস্টার ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছিল।
এই গরমিল সমাধানের জন্য গির্জার পক্ষ থেকে ১১ দিন যোগ করে প্রবর্তন করা হয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, যা এখন আমরা অনুসরণ করি। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির বিষয়ে বেশ কিছু মজাদার তথ্য আছে। ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত ফ্রান্স ব্রিটেন কিংবা জার্মানি এরা কেউ এই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহন করেনি। তারা মনে করতো এগুলো সব ক্যাথলিকদের ষড়যন্ত্র।
আর রাশিয়াতে তো ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের আগ পর্যন্ত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ছিল রাশিয়ার সরকারী ক্যালেন্ডার।
এসডব্লিউএসএস/০৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ