কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতে আমরা শূন্য সংখ্যাটি ব্যবহার করি। শূন্য, নালা, সিফর, জেবেরো ইত্যাদি কত নামেই ডাকা হয় শূন্যকে। এই শূন্য সংখ্যাটি ভারী কৌতুহলপূ্র্ণ। বলা যায় রহস্যময়। যেমন ধরুন কোন সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করতে গেলে সৃষ্টি হয় রহস্যের। ভাগটা মেলে না৷ গণিতশাস্ত্রে এ এক মহারহস্য ৷
আবার পদার্থবিজ্ঞান বলে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়৷ সেখানে চলতে থাকে কণা-প্রতিকণাদের প্রতিনিয়ত সৃষ্টি ধ্বংস। শূন্য সংখ্যাটি যেমন রহস্যময় তেমনি রহস্যে ঘেরা এর জন্ম ইতিহাস।
সেসব কথা থেকে বেরিয়ে এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেখুন সংখ্যা জগতে অন্য নয়টি অঙ্কের আবির্ভাব কিন্তু হয়ে গেছে শূন্যের আগেই। তাহলে আগে মানুষজন কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতো কী করে?
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সুমেরীয় লিপিকররা কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতে স্পেস বা ফাঁকা জায়গা ব্যবহার করতো। কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতে প্রথম কোন প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয় আজ থেকে চার হাজার বছর পূর্বে ব্যবলীয়নদের হাতে। তারা দুটো কীলক আকৃতির প্রতীক ব্যবহার করতে শুরু করে কোন কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতে। তবে সুমেরীয় আর ব্যবলীয়নরা এই প্রতীক দিয়ে কোনোরকম গাণিতিক হিসেব নিকেশ করতে জানতো না।
৩৫০ কমন এরা বা সাধারণ যুগে মায়ান সভ্যতার মানুষেরাও শূন্যকে বোঝাতে একটা প্রতীক ব্যবহার করতো। কিন্তু তারাও জানতো না কি করে এটা নিয়ে গাণিতিক হিসেব-নিকেশ কষতে হয়। একটা গাণিতিক সংখ্যা হিসেবে শূন্যের ব্যবহারের শুরুটা ঠিক কোথায় সেটা স্পষ্ট করে জানা যায় নি এখনো।
পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়ে ধরা হতো সংখ্যা হিসেবে শূন্যের ব্যবহার শুরু হয় ভারতবর্ষে। ভারতের গোয়ালিয়র শহরের একটা মন্দিরের ভেতরে পাওয়া যায় একটা লিপি যেখানে শূন্য সংখ্যাটির উপস্থিতি ছিল।
১৮৮৩ সালে জার্মান ভারততত্ত্ববিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ ইউজেন জুলিয়াস থিওডর হাল্টজস্ক সেই লিপির একটা কপির ইংরেজি অনুবাদ লিখেন। সেই সাথে জানান যে এই লিপিটি আসলে ৮৭৬ কমন এরার। এই লিপিকে ভরসা করেই শূন্যের জন্ম প্রাচীন ভারতে এই বিষয়টা সর্বজনগৃহীত হয়।
১৮৯১ সালে বর্তমান কম্বোডিয়ার মেকং নদীর ধারে অবস্থিত সম্বর নামক গ্রামে একটি ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকদল একটি পাথরের স্তম্ভের লিপির পাঠোদ্ধার করেন। লিপিটিতে ৬০৫ খমের সন উল্লেখিত ছিল। খমের সন আসলে ঐতিহাসিক ইন্ডিয়ান সাকা বর্ষপঞ্জির অন্তর্গত বছর গণনা পদ্ধতি।
সাকা বর্ষ গণনা পদ্ধতির শুরু হয় প্রাচীন ভারতীয় শাসক শালিবাহানার শাসনকাল থেকে। এই পদ্ধতি জুলিয়ান বর্ষ গণনা পদ্ধতি শুরু হবার ৭৮ বছর পর থেকে শুরু। সে অনুসারে জুলিয়ান বর্ষ গণনা পদ্ধতিতে সময়টা হবে ৬৮৩ কমন এরা ৷ সুতরাং শূন্যের জন্ম তাহলে প্রাচীন কম্বোডিয়ায়।
কিন্তু বিষয়টা এখনো অধরাই বলা যায়। এ নিয়ে চলছে গবেষণা। তখনো বিষয়টা মানুষের মধ্যে এতটা সাড়া ফেলতে পারে নি। অর্থাৎ শূন্যের জন্মস্থানের স্বীকৃতি ভারতীয়দের কাছেই রয়ে গেলো।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যাতাকলে কম্বোডিয়ায় পাওয়া পাথরে লেখা লিপির কথা মানুষ ভুলে যায় ৷ প্রায় এক শতাব্দী পরে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক আমির একজেল সম্বরের সেই প্রস্তর লিপিটিকে খুঁজে বের করেন। তিনি ২০১৫ সালে তার প্রকাশিত বই ”ফাইন্ডিং জিরো” তে সম্বর গ্রামে পাওয়া সেই প্রস্তর লিপির কথা উল্লেখ করেন।
শূন্যের জন্মরহস্যের জল আরো ঘোলা হয় যখন প্রত্নতাত্ত্বিবিদেরা দক্ষিন এশিয়ার প্রাচীন মালয় সাম্রাজ্য শ্রীবিজয়াতে তিনটি পাথরের লিপির সন্ধান পান ৷ লিপি তিনটিতে ৬০৫, ৬০৬ এবং ৬০৮- এই তিনটা খমের সন লিখা ছিল। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে সন তিনটি হবে যথাক্রমে ৬৮৩, ৬৮৪ এবং ৬৮৬ সি.ই. (কমন এরা) । পাথর তিনটির নাম রাখা হয় সেগুলোর প্রাপ্তিস্থান এর নামানুসারে; কেদোয়ান বুকিত, তালাং তুও এবং কোটা কাপুর।
ধারণা করা হয় যে পাথর লিপি তিনটি সাত শতাব্দীর। যদি তাই-ই সঠিক হয় তাহলে শূন্যের জন্ম ভারতের গোয়ালিয়র মন্দিরে পাওয়া লিপিরও দুই শতাব্দী পূর্বে!
সুতরাং শূন্য সংখ্যার উৎপত্তি আসলে কোথায়? সেটা কি দক্ষিণ এশিয়ায়? খমের সন গণনা কি শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি থেকে এসেছে? শূন্যের ব্যবহার কি কম্বোডিয়ার সম্বর গ্রাম থেকে ভারতে বিস্তৃত হয়েছিলো যা পরে ইউরোপে বিস্তৃত হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অধরাই হয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে গণিতের ইতিহাস রহস্যে ভরপুর।
এসডব্লিউএসএস/০৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ