বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালক ও বাহক হলো স্টক এক্সচেঞ্জ বা শেয়ারবাজার। পুঁজিবাদের বিকাশে শেয়ারবাজারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আর বিশ্বের প্রথম দিকের স্টক এক্সচেঞ্জের গল্প বলতে হলে প্রথমেই আসবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম। এরাই প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন করেছিল।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাচ শিপিং শিল্পের বিকাশের জন্য দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় ব্যস্ত থাকতো। আমস্টারডাম এবং জিল্যান্ড থেকে যাত্রা করা অনেক জাহাজই গন্তব্যে পৌছনোর আগেই দেউলিয়া হয়ে যেতো। এছাড়াও ডাচ বণিকরা বরাবরই একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত থাকতো। প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীর পুরো যাত্রাকে ভণ্ডুল করার জন্য ডাচ বণিকরা নাবিকসহ জাহাজের সকল কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতো। আর এই প্রবণতা ১৬০২ সাল পর্যন্ত চলেছিল। প্রতিনিয়তই অভিযোগ বাড়তে থাকে।
এই অবস্থায় হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় ডাচ প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ শাসক সংস্থা। কারণ নিজেদের এই দুর্নীতির সুযোগে পর্তুগিজরা ঠিকই ডাচদের ব্যবসার পথগুলো দখল করে নিচ্ছিল। দেশের অর্থনীতির উন্নতি এবং পর্তুগিজদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কগুলো রক্ষা করার জন্য একটি সনদ জারি করে ডাচ কর্তৃপক্ষ। ওই সনদ অনুসারে ডাচ কোম্পানিগুলোকে একটি একক উদ্যোগে যুক্ত করা হয়। ওই এন্টারপ্রাইজটির নামকরণ করা হয় ভেরিনিগডে ওস্টিন্ডিশ কোম্পানি বা ভিওসি। এতে বলা হয়, ডাচ রিপাবলিক এবং পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যে কোনো বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার পাবে এর সদস্যরা।
আর ওই এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে প্রথম বাণিজ্যিক অভিযানের জন্য প্রচুর পরিমাণে মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। ভিওসি-এর দশ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে নাগরিক ও বণিকরা সেখান থেকে শেয়ার কিনতে পারতেন। এই নিয়ম করার পর দেশের ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চাকরদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল তখন। প্রাথমিক পাবলিক অফার শেষে ভিওসি দ্বারা ৩৬,৭৪,৯৪৫ গিল্টার সংগ্রহ করেছিল।
ভিওসি গঠনের আগেও মানুষ একে অন্যের কাছে অর্থ গচ্ছিত রাখতো। তবে দু’পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ পেশাদারের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ছিল। ওই অর্থ তখন ব্যবসায়ে খাটানো হতো না। অন্যদিকে, ভিওসি গ্রাহক বা শেয়ার হোল্ডারদের বলেছিল, তারা কোথাও বিনিয়োগ করেছে এবং তার লভ্যাংশ ভাগাভাগি করা হবে। যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে চার্টার লেখকরা একটি অতিরিক্ত আইন যুক্ত করে। ওই আইন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডাররা তাদের শেয়ার অন্য বিনিয়োগকারীদের নিকট বিক্রি করার অনুমতি পান। আর এই হস্তান্তরের মধ্যদিয়ে ভিওসি শুধুই শেয়ার ইস্যু করা বিশ্বের প্রথম কোম্পানিই নয়, বরঞ্চ শেয়ার লেনদেনকে উৎসাহিত করা প্রথম কোম্পানির খেতাব অর্জন করে।
ভিওসিতে লেনদেন করা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন জান অ্যালার্টজ টট লন্ডেন। তার জাহাজ নেদারল্যান্ডস ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি চুক্তি করেছিলেন। শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে টট লন্ডেনের যুক্তি ছিল দুটি। প্রথমত তার ক্ষেত্রে পরবর্তী কিস্তির জন্য অর্থ প্রদানের প্রয়োজনিয়তা ছিল না। আবার তার নিজের কোম্পানির শেয়ার বাড়ার কারণে তিনি নিজেও আরও বেশি বিনিয়োগ পাচ্ছিলেন। তিনি আশা করেছেন, এক সময় তিনি নিজের কেনা শেয়ারগুলোও বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। সময়ের সাথে সাথে অনেক ডাচ বিনিয়োগকারী অ্যালার্টজের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। ওই সময়ের প্রকাশিত এক নথিতে জানা যায়, ওই মাসে এমন আরও ৮টি লেনদেন হয়েছিল। তবে এই ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি একবারও সামনে আসেনি। এমনকি ভিওসি-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিকতা লাভ করতে থাকে ডাচদের ওই শেয়ারবাজার। অ্যালার্টজ তার শেয়ার বিক্রি করার জন্য নিজে উপস্থিত থেকে ক্রেতাকে নিয়ে তৎকালীন ভিওসি পরিচালক ডার্ক ভ্যান ওসের ব্যক্তিগত বাসভবনে যেতে হয়েছিল। সেখানে দুইজন ভিওসি কর্মচারীর সাক্ষ্য এবং অনুমোদন নিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। আর নিজেদের মধ্যে বাকি আলাপ আলোচনা হতো আমস্টারডামের রাস্তায়। সেখানে দরকষাকষি যেমন হতো তেমনি চলতো মারামারিও। চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারলে কিলঘুষি ছিল সেখানকার নিত্যদিনের ঘটনা।
শেয়ারের এই ব্যবসার জন্য আলাদাভাবে প্রচারণা চালাতে হয়নি। বরঞ্চ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শেয়ার কেনার জন্য। দিন দিন মানুষের ভিড় বাড়ায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ একটি নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করে। শহরের কেন্দ্রস্থল খ্যাত দামরাকের নিকটে অবস্থিত সেন্ট ওলাফের চ্যাপেলটিকে বিশ্বের প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ ভবন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সেখানে মূলত লবণ, শস্য এবং কাঠের মতো পণ্যের পাশাপাশি মজুদ ব্যবসা করা হতো। তবে এটি নিয়েও কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।
ফার্নান্ড ব্রাউডেল তার সভ্যতা এবং পুঁজিবাদে লিখেছেন, ১৩২৮ সালের আগে ফ্লোরেন্স এবং জেনোয়ার কাসা ডি সান জিওর্জিওর লুঘি এবং পাগে একটি সক্রিয় বাজার ছিল। সেখানে রাষ্ট্রীয় ঋণের স্টক আলোচনা করা হতো। তবে এটিকে প্রথম শেয়ার বাজার বলার সাপেক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ দাঁড় করাতে পারেননি ইতিহাসবিদরা।
এছাড়াও পঞ্চদশ শতকে লাইপজিগ মেলাতেও ঋণ বিতরণ করা হতো। যাইহোক, আমস্টারডাম সম্পর্কে ব্রাউডেল পুরোপুরি তুলে ধরতে পারেননি। ভিওসি-তে শেয়ার ট্রেডিং-এর শুদ্ধতম অর্থের প্রভাব ছিল। কারণ সেক্ষেত্রে লাভ বা লোকসান কোনটি হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তখনকার সময়ের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে এই মূল্যায়ন কৌশল বাস্তবায়নকে উন্নীত করেছে যা আজকের স্টক মার্কেট নামে পরিচিত।
প্রায় ৩০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম বর্তমান ওয়াল স্ট্রিটের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে পুরনো এই স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায়, স্প্যানিশ-ইহুদি লেখক জোসেফ পেনসো দে লা ভেগা দ্বারা লেখা বই দ্য কনফিউশন অব কনফিউশন্স থেকে। ১৬৮৮ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। একজন দার্শনিক, একজন বণিক এবং একজন অভিজ্ঞ স্টক ব্রোকারের মধ্যে প্লেটোনিক কথোপকথন নিয়ে লেখা সবচেয়ে পুরনো বই এটি। দে লা ভেগা স্টক এক্সচেঞ্জকে সেকালের সবচেয়ে ব্যস্ততম দফতর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অনেকে সেখানে সব হারিয়ে চিল্লাচিল্লি করতেন আবার অনেকে বিপুল অর্থ আয় করে উদযাপন করতেন। আবার সেখানে দালাল গোষ্ঠীও মাথাচড়া দিয়ে উঠে। ওই দালালরা সবসময় গ্রাহকদের ঠকানোর চেষ্টা করতো।
তবে ওই স্টক এক্সচেঞ্জ ডাচ অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। সেকালের আন্তঃমহাদেশীয় অভিযান যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি ব্যয়বহুলও ছিল। ভিওসি তৈরির আগে, বেশিরভাগ বণিক কোম্পানি চার বছরের বেশি সময় ধরে অভিযানে থাকতে পারেননি। স্টক ইস্যু করে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একবারে একাধিক সমুদ্রযাত্রার পরিকল্পনা করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন তৈরি করতে পেরেছিল। সেকালের ভিওসিতে জমা থাকা অর্থেক আজকের বাজারমূল্য ছিল ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির হিসাবে এটি আজকের যুগের অ্যাপলের মূল্যের চেয়ে চারগুণ বেশি। এখন পর্যন্ত এটি ইতিহাসে যেকোনো কোম্পানির সর্বোচ্চ মূল্যায়ন।
তবে ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সকল সফলতার জন্য শেয়ার বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিল না। বরঞ্চ এই স্টক মার্কেটের কারণে এটি সেকালে তার প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, ডাচরা এই শেয়ার বাজার বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করেনি। তবে আজকের স্টক মার্কেটের প্রকৃত ধারণার জন্য তাদেরকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ