যুগ যুগ ধরেই মানুষ আর ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়া পাশাপাশি বাস করে চলেছে। মানুষ যতবারই নানারকম প্রতিষেধক আবিষ্কার করে, ওষুধ আবিষ্কার করে তাদের প্রতিহত করতে চেয়েছে, বারাবরই তারা জেনেটিক মিউটেশন ঘটিয়ে নতুন রূপে ফিরে ফিরে এসেছে।
ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়া সঙ্গে মানুষের এই যুদ্ধ অপরিসীম। এখন প্রশ্ন হল যদি এমন কিছু মাইক্রোবসের সম্মুখীন আমাদের হতেই হয়, হাজার হাজার বছর আগে যাদের অস্তিত্ব এই বিশ্ব থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন দিন কিন্তু আসতে চলেছে। আর বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণঘাতী অতীতের অনেক মাইক্রোবস ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তবে সেই দিন আর দূরে নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভস্থ প্রাচীন চিরহিমায়িত অঞ্চলের গলে যাওয়া মানবজাতির জন্য নতুন হুমকি আজ। রাশিয়ার সাইবেরিয়ার চিরহিমায়িত অঞ্চলের বরফের নিচে পাওয়া ভাইরাসকে পুনরুজ্জীবিত করা একদল গবেষক নতুন এই হুমকির তথ্য জানিয়েছেন।
এই গবেষকরা প্রায় দুই ডজন ভাইরাস পুনরুজ্জীবিত করেছেন, যার মধ্যে একটি ভাইরাস সাড়ে ৪৮ হাজারের বেশি সময় পরও বরফের নিচে সংক্রামক অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন।
ইউরোপীয় গবেষকরা রাশিয়ার সাইবেরিয়ার চিরহিমায়িত অঞ্চলের একটি হ্রদ থেকে সংগৃহীত প্রাচীন নমুনা পরীক্ষা করেছেন। তারা ১৩টি নতুন জীবাণু পুনরুজ্জীবিত এবং এসব জীবাণুর বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করেছেন। আর এসব ভাইরাসকে গবেষকরা ‘জম্বি ভাইরাস’ নাম দিয়েছেন।
গবেষকরা হিমায়িত মাটিতে আটকে থাকার পর বহু সহস্রাব্দ কাটিয়েও ভাইরাসগুলো সংক্রামক রয়ে গেছে বলে দেখতে পেয়েছেন।
বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়নের কারণে হিমায়িত অঞ্চলের গলিত মিথেনের মতো পূর্বে আটকে থাকা গ্রিনহাউস গ্যাস মুক্ত হয়ে গেলে জলবায়ু পরিবর্তন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে দিয়ে আসছেন। কিন্তু সুপ্ত জীবাণুর ওপর এর প্রভাব কম বোঝা যায়।
রাশিয়া, জার্মানি এবং ফ্রান্সের গবেষক দলটি বলেছে, তারা যেসব ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জীবতাত্ত্বিক ঝুঁকি ছিল একেবারে নগণ্য। তবে অ্যামিবা জীবাণুকে সংক্রমিত করার সক্ষমতা রয়েছে এসব ভাইরাসের।
কিন্তু প্রাণী বা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে এমন একটি ভাইরাসের সম্ভাব্য পুনরুজ্জীবনকে অনেক বেশি আশঙ্কাজনক বলে চিহ্নিত করছেন গবেষকরা। এই ভাইরাসের পুনরুজ্জীবন বাস্তব ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন।
নতুন গবেষণায় এই ভাইরাসের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ প্রিপ্রিন্ট পেপারে প্রকাশ করেছেন তারা। তবে এই গবেষণাটি এখনও জীববিজ্ঞানবিষয়ক ওপেন অ্যাকসেস ওয়েবসাইট বায়ো-আর্কাইভের সার্ভারে পিয়ার-রিভিউ করা বাকি রয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, প্রাচীন চিরহিমায়িত অঞ্চল গলে যাওয়ার ফলে এসব অজানা ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে পারে।
তারা বলেছেন, এসব ভাইরাস একবার বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসার পর কতক্ষণ সংক্রামক থাকতে পারে এবং উপযুক্ত বাহকের মুখোমুখি ও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, তা এখনও অনুমান করা অসম্ভব।
এর আগে ২০১৬ সালে সাইবেরিয়ার এক ১২ বছরের শিশু অ্যান্থ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন, বহু বছর আগে ওই এলাকায় অ্যান্থ্রাক্সের কবলে প্রচুর রেনডিয়ারের মৃত্যু হয়েছিল। সেই দেহগুলো বরফের নীচে চাপা পড়েছিল।
বিশ্ব উষ্ণায়নে বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গেই মৃতদেহে চাপা পড়ে থাকা জীবাণু বাইরে বেরিয়ে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে। কোনও ভাবে জল এবং খাবারের সঙ্গে মিশে গিয়েই ওই শিশুর সংক্রমণ ঘটায়।
শুধু এই একটা ঘটনাই নয়, গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকা একাধিক প্রাণঘাতী জীবাণুর খোঁজ পেয়েছেন। যেমন ২০০৫ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা আলাস্কার একটি বরফ হ্রদ থেকে ৩২ হাজার বছরের পুরনো এক ব্যাক্টিরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন। এর দু’বছর পর ২০০৭ সালে আন্টার্কটিকার বরফে চাপা পড়ে থাকা ৮০ লক্ষ বছর পুরনো এক ব্যাক্টিরিয়ার সন্ধানও পেয়েছেন।
১৯১৮ সালে সারা বিশ্বের ত্রাস হয়ে উঠেছিল স্প্যানিস ফ্লু। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই সংক্রমণের জেরে। আলাস্কার তুন্দ্রায় বরফের তলার গণ কবর দেওয়া হয়েছিল মানুষদের। সেই জায়গা থেকেই স্প্যানিস ফ্লু ভাইরাসের জেনেটিক অংশ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এমনকী একই ভাবে সাইবেরিয়ায় বরফের তলা থেকে গুটি বসন্ত এবং বিউবোনিক প্লেগ-এর ভাইরাসও মিলেছে। ১৮৯০ সালে সাইবেরিয়াতে মহামারি আকার নিয়েছিল গুটি বসন্ত। ৪০ শতাংশ জনবসতি সাফ হয়ে গিয়েছিল এই রোগে।
ফ্রান্সের এইক্স-মারসেলি ইউনিভার্সিটি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবসের জন্য খুব ভাল সংরক্ষকের কাজ করে বরফের স্তূপ। কারণ অত্যন্ত ঠান্ডা, কোনও অক্সিজেন নেই এবং সূর্যের আলোও পৌঁছায় না। ফলে যুগ যুগ ধরে বরফের তলায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে এরা।
পৃথিবীর দুই প্রান্তে বছরের পর বছর ধরে যে বরফের আস্তরণ জমা হয়ে রয়েছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে তা প্রতিদিনই গলতে শুরু করেছে। ফলে বরফ স্তূপের গভীরে চাপা পড়ে থাকা এই সমস্ত প্রাণঘাতী ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়াও ফের সক্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণাটি ‘মধ্যম’ মাত্রার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালনা করা হয়েছে; যেখানে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা গড়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ