ডিসেম্বর ২, ২০১০। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফার সদর দপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজন করবে কোন দু’টি দেশ। দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিবর্গ। ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন, ইংল্যান্ডের পক্ষে প্রিন্স উইলিয়াম। আরও ছিলেন নেদারল্যান্ডের বর্তমান ও বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একটা কক্ষে এতো এতো রাজনৈতিক পাওয়ারহাউজের উপস্থিতি সত্ত্বেও অনুষ্ঠানের যাবতীয় ক্ষমতা ছিল ফিফার ২২ কর্মকর্তার হাতে। আর আমরা সবাই জানি, এই ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণই সকল দুর্নীতির জন্মদাত্রী।
উল্লেখ্য, ফিফা আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ১৯৩০ সালে প্রথম ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়কার ফিফা সভাপতি জুলে রিমে এই ধারণাটি পেশ করেন। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ফিফা বিশ্বকাপে আমন্ত্রিত হয়ে মাত্র তেরটি দল চূড়ান্ত টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। প্রথম এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে, উরুগুয়েতে৷ এই বিশ্বকাপের নিলাম নিয়ে আছে বড়সড় প্রশ্ন। যদিও তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। ওই সময় ফিফার সদস্য দেশ ছিল ৪৪ টি। তাদের মধ্যে ৬ টি দেশ নিলামে অংশগ্রহণ করে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, নিলাম নয় বরং আয়োজক কে হবে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। যেখানে উঠে আসে উরুগুয়ের নাম এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে স্বাগতিক উরুগুয়ে৷
এই বিশ্বকাপে উরুগুয়ে দুটি অলিম্পিক গোল্ড জিতেছিল। তাই ভাবা হয়, উরুগুয়েই ছিল যোগ্য দেশ। তবে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল অন্যদেশগুলোকে। সেসময় মূলত উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ অ্যামেরিকার দলগুলো বিশ্বকাপে অংশ নেয়৷ ইউরোপ থেকে স্টিমশিপে চেপে সেই বিশ্বকাপে অংশ নিতে যায় চারটি দল৷ বড় অঙ্কের পরিবহন খরচ মেটাতে হয় দেশগুলোকে। এর পরবর্তী দুই দশকে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনে বেছে নেয় ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকাকে। ৬০ ও ৭০-এর দশকে ফিফার সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৮০-এর দশকে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭০-এ।
পাশাপাশি চিন্তাতীতভাবে ধনী হতে থাকে ফিফা। স্পনসরশীপ, মার্চেনডাইজ ও টিভির সত্ত্ব থেকে আসা বিশাল অঙ্কের এই অর্থ নিয়ন্ত্রণ করত ফিফার ২৪ জন কর্মকর্তা। এদের বলা হতো এক্সিকিউটিভ কমিটি বা এক্স কো। তারা এই অর্থ সদস্য দেশগুলোকে ফুটবল মাঠ, টুর্নামেন্ট ও অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যয় করতে সরবরাহ করত। এখানেই শুরু দুর্নীতির। যার শেষ ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে। তবে আক্ষরিক অর্থে এই দুর্নীতির শেষ কোথায়, তা জানা নেই কারও।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ভোটে ২০১৮ বিশ্বকাপের স্বাগতিক সত্ত্ব পায় রাশিয়া এবং ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয় কাতার। তবে এর কিছুদিন পর থেকেই ওই ভোটাভুটি নিয়ে সন্দেহ ও দুর্নীতির গুঞ্জন শুরু হয়।
এরপর বিশ্ব ফুটবলে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার পরই ২০২০ সালে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য জানায় সংস্থাটি। জানানো হয়, ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক সত্ত্ব পেয়েছে রাশিয়া ও কাতার।
ফিফা-২০১০ নির্বাহী কমিটির দক্ষিণ আমেরিকার তিন সদস্যের বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। ব্রাজিলের রিকার্দো তিজেইরা, প্যারাগুয়ের নিকোলাস লেওস ও এই ষড়যন্ত্রে একজন সাহায্যকারী (নাম অজানা) ২০২২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচনে কাতারকে ভোট দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছিলেন ।
যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতি মামলায় লড়াই করতে থাকা লেওস গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান। আর তিজেইরা ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিভিন্ন ফুটবল প্রতিযোগিতার মার্কেটিং ও মিডিয়া স্বত্ব পাইয়ে দেওয়ার জন্য ঘুষ নেওয়ার দায়ে আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন। ২০১৫’র ২৭ মে জুরিখে দুর্নীতির অভিযোগে ফিফার সাত কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। তার দুদিন পর তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ বাটার পঞ্চমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও কদিন পরেই ফিফাকে ঘিরে ঘুষ কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু হওয়ায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরে সেসবে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ হন ১৬ বছরের বেশি ফিফা প্রধানের দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তা।
যদিও রাশিয়া ও কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক করা নিয়ে সব রকমের দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখন এক বিবৃতিতে ফিফা জানিয়েছে, সব ‘অপরাধমূলক অন্যায়ের অভিযোগ’ তদন্তের পক্ষে তারা, ‘(যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের দেওয়া) অভিযোগপত্রে যে ফুটবল কর্মকর্তাদের কথা বলা হয়েছে, ফিফা এথিকস কমিটি আগেই তাদের আজীবন নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করেছে।’
রাশিয়া বিশ্বকাপ
ইংল্যান্ড যৌথভাবে আয়োজন করতে ইচ্ছুক হল্যান্ড-বেলজিয়াম ও স্পেন-পর্তুগালকে হারিয়ে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের সত্ত্ব পেয়েছিল রাশিয়া। তবে এর পেছনে আছে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিসন্ধি। যা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর প্রতিবেদনে।
অভিযোগে নাম এসেছে ফিফার সাবেক সহ-সভাপতি জ্যাক ওয়ার্নারেরও। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক সত্ত্ব রাশিয়াকে পাইয়ে দিতে ওয়ার্নারকে ৪ মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার দৌড়ে ইংল্যান্ডকে পেছনে ফেলে সত্ত্ব পায় রাশিয়া।
ফিফার আরেক সাবেক নির্বাহী সদস্য ও গুয়াতেমালার ফুটবল প্রধান রাফায়েল সালগুয়েরো ঘুষ নেওয়ার বিনিময়ে রাশিয়াকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দুর্নীতির দায় শিকার করা সালগুয়েরোকে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা।
শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে প্যারাগুয়েতে নিজ বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায় মারা যান কনমেবলের সাবেক সভাপতি নিকোলাস লিওজ। সে সময় চেষ্টা করেও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে পারেননি তিনি। ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে মিডিয়া সত্ত্ব ও বিভিন্ন ধরনের ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে ঘুষ নেওয়ায় টিসেইরাকে আজীবন নিষিদ্ধ করে রেখেছে ফিফা। ওয়ার্নারও আজীবন নিষিদ্ধ আছেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাসংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগে ফিফা প্রায় নিয়মিতভাবে বিদ্ধ হতে শুরু করে ২০১০ সাল থেকে।
কাতার বিশ্বকাপ
এফবিআই-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পেয়েছে ধনী দেশ কাতার। অভিযোগপত্রে বলা হয়, আয়োজক নির্ধারণে ফিফার নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সাবেক সদস্য ঘুষের প্রস্তাব পান। সেই প্রস্তাব তারা গ্রহণ করে কাতারের পক্ষে ভোট দেন।
উল্লেখ্য, বিশ্বকাপের আয়োজক ইস্যুতে কারচুপির অভিযোগে নিষিদ্ধ হন সাবেক ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার। চলতি বছরের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের একটি আদালত তাকে অব্যাহতি দেন। সেই সঙ্গে অব্যাহতি পান তার সঙ্গে অভিযুক্ত মাইকেল প্লাতিনিও।
সেপ ব্লাটার ফিফার প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের নাম ঠিক করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে ২২তম বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার অনুমতি পায় কাতার।
সেই ব্লাটার সম্প্রতি বলেছেন, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নাকি ভুল ছিল। সুইস আউটলেট তেজেস অ্যানজেইগারকে ব্লাটার বলেন, ‘কাতারকে আয়োজক হিসেবে ঠিক করার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, ২০১৮ সালে রাশিয়া আর ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি পরাশক্তির দেশ। তারা পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করলে খুব ভালো হতো।’
কাতারের আয়োজক হওয়ার সিদ্ধান্তকে ঠিক কী কারণে ভুল বলছেন ব্লাটার? তার ভাষ্যমতে, ‘এটা (কাতার) খুব ছোট দেশ। ফুটবল আর বিশ্বকাপ সে হিসেবে অনেক বড় পরিসরের ব্যাপার-স্যাপার। আমার জন্য বিষয়টি পরিষ্কার, সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল।’
কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেক সাবেক তারকা ফুটবলাররা। তাদের একজন ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানির অধিনায়ক ফিলিপ লাম। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কাতারে না যাওয়ার কারণ জানিয়েছেন এই ফুটবলার। তিনি বলেন, একজন অফিশিয়াল প্রতিনিধি কিংবা একজন ভক্ত হিসেবেও আমি কাতারে যাচ্ছি না। যে দেশকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়, সেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত।
কাতারের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে যে গুটিকয়েক দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সমালোচনা করে, নেদারল্যান্ডস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (কেএনভিবি) তাদের মধ্যে একটি। কেএনভিবি কখনই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ছিল না এবং অবশ্যই যেভাবে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ করা হয়, তা অনুমোদন করে না।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সফলভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করা রাশিয়া ওই প্রতিবেদন নিয়ে মোটেও আগ্রহ দেখায়নি। তবে আগামী বিশ্বকাপ আয়োজন করবে বলে ওই প্রতিবেদনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে কাতার।
এক বিবৃতিতে কাতার বলে, ‘বছরের পর বছর মিথ্যা দাবি তোলা হলেও কাতার অনৈতিকভাবে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজনের স্বত্ব পেয়েছে বা ফিফার কঠোর বির্ডিংয়ের নিয়ম ভঙ্গ করেছে, এমন কোনো প্রমাণ কখনও পাওয়া যায়নি। এমনকি কোথাও নেই।’
দেশের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগে মুখ খুলেছে কাতারের সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লেগাসি (এসসি)। তারা জানায়, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং এসব কঠোরভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বকাপের আয়োজক নির্ধারণে সকল নিয়ম কঠোরভাবে মানা হয়েছে।’
এসডব্লিউএসএস/১৪১১
আপনার মতামত জানানঃ