কানাডার ওটাওয়া শহর। কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জুওলজি বিভাগ। শিক্ষার্থীদের সামনে ব্যাঙ-এর ডেমনস্ট্রেশন দিচ্ছেন এক অধ্যাপক। টেবিলের ওপর কাচের পাত্রে রাখা একটি বরফের খণ্ড। শুধু বরফ নয়। তার ভিতরই জমাট বেঁধে আছে আস্ত একটি ব্যাঙ। স্পন্দন নেই কোনো, নেই নড়াচড়াও।
বরফখণ্ডটি এবার জলভর্তি একটি পাত্রে ডুবিয়ে দিলেন অধ্যাপক। তারপর কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন ঘটে গেল আশ্চর্য ঘটনা। বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় লাফ দিয়ে পাত্র থেকে বেরিয়ে এল ছোট্ট ব্যাঙটি।
কী ভাবছেন, এই ঘটনা কোনো ম্যাজিক? না, একেবারেই তেমনটা নয়। প্রকৃতির বিচিত্র সৃষ্টি এই বিশেষ প্রজাতিটি। আয়তনে মানুষের কনিষ্ঠাঙ্গুলির থেকে ছোটো হলেও, এই ব্যাঙের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক ক্ষমতা।
বা বলা ভালো, চরম প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেই বিবর্তনের এই আশ্চর্য পথে হেঁটেছে এই প্রাণীটি।
আলাস্কান উড ফ্রগ (Alaskan Wood Frog)। আর্কটিক সার্কেল মধ্যে অবস্থিত হওয়ায়, চিরকালই শীতের দাপট থাকা আলাস্কায়। বছরের বেশিরভাগ সময়েই সেখানকার তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে। স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এই তাপমাত্রা সয়ে গেলেও, শীতলরক্তের প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই পরিবেশে বেঁচে থাকা এক-কথায় অসম্ভব। তবে এই প্রতিকূলতার সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে আলাস্কান উড ফ্রগ।
সাধারণত এই ব্যাঙের দেহের দুই-তৃতীয়াংশই নির্মিত জল দিয়ে। শীতকালে তা সম্পূর্ণভাবে জমাট বেঁধে পরিণত হয় বরফে। জমাট বাঁধে রক্তও। বন্ধ হয়ে যায় হৃদপিণ্ড। তবে গোটা দেহ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেও প্রাণ যায় না এই প্রাণীটির।
শীতের পর বসন্তের আগমনে যখন একটু একটু করে পারদ চড়ে আলাস্কায়, তখন ফের সজীব হয়ে ওঠে উড ফ্রগরা। ফের শুরু হয় রক্তপ্রবাহ। তবে একদিন দুদিন নয়, টানা মাস সাতেক এভাবেই জমাট বেঁধে থাকতে পারে এই ব্যাঙ। কাজেই শীতঘুম না বলে, এ-হেন ঘটনাকে ধ্যানমগ্নতা বলাই যায় অনায়াসে! কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয় এমনটা?
এই আশ্চর্য ক্ষমতার পিছনে দায়ী ব্যাঙের দেহে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন। গ্রীষ্ম কিংবা বসন্তে দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেই প্রচুর পরিমাণ গ্লাইকোজেন সংগ্রহ করে রাখে উডফ্রগ। ফলে রক্ত জমাট বাঁধলেও, কোষে কোষে খাদ্য সরবরাহের সমস্যা থাকে না কোনো।
এই গ্লাইকোজেনকেই গ্লুকোজে পরিণত করে প্রতিটি অঙ্গে শক্তি সরবরাহ করে আলাস্কান উড ফ্রগ। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে আরও বেশি মাত্রায় তৈরি হয় গ্লুকোজ। শিথিল হয় শরীরের পেশি। কাজেই ফের চলচ্ছক্তি ফিরে পায় তারা।
এছাড়া, কোনও প্রাণীই মল-মূত্র ত্যাগ না করে বেঁচে থাকতে পারে না। খুব জোর ঘন্টা খানেক বন্ধ করে রাখা যেতে পারে। তবে, সেই বন্ধ করার ফলে শারীরিক নানা সমস্যার বা চাপের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু আলাস্কার এই উড ফ্রগ টানা ৮ মাস রেচন ক্রিয়া বন্ধ রেখে দিব্য বাঁচতে পারে।
তীব্র ঠান্ডায় নিজের ইউরিনকেই কাজে লাগায় উড ফ্রগ। উপকারী নাইট্রোজেনের সাহায্যে তারা শীতকালে শরীরকে আরও ঠান্ডা করে রাখে। শুধু তাই তয়, শীতকালীন সময়টাতে শরীরের টিস্যু ও কোষগুলিকে রক্ষা করতেও এই বের না হওয়া ইউরিন অত্যন্ত কাজে লাগে। এছাড়া হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এই ইউরিন কাজে লাগাই ক্ষুদ্র জীবটি। আর এটি করতে সক্ষম হয় এই প্রজাতির ব্যাঙ কারণ তাদের শরীরের ভিতর স্পেশাল মাইক্রোবস রয়েছে, যার ফলে তারা ইউরিনকে রিসাইকেল পদ্ধতিতে চালনা করতে পারে।
এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে রয়্যাল সোশ্যাইটির একটি জার্নালেও। উল্লেখ্য, শীতযাপন করে এমন অনেক প্রাণীই মূত্রত্যাগ করে। কিন্তু উড ফ্রগের মতো কেউ এমনটা করতে পারে না।
তবে মজার বিষয় হল, চরম প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আয়ত্ত করলেও, অনেক সময় জমাট বাঁধা অবস্থাতেও খাদকদের শিকার হয়ে থাকে এই ব্যাঙ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ