পৃথিবী যেন এক গোলকধাঁধা। তবে এই গোলকধাঁধার সৃষ্টির ইতিহাস আজও বিস্ময়কর। কথায় বলে পানিই জীবন। পানি থেকেই জীবনের সৃষ্টি। এই সত্য সামনে এসেছে বহুকাল আগেই। কিন্তু পৃথিবীতে পানি এলো কোথা থেকে, তাই নিয়েই নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ পানির উৎপত্তি থেকেই জানা যাবে পৃথিবী সৃষ্টির আদি রহস্য। চলুন জানা যাক সাম্প্রতিক এক গবেষণা সম্পর্কে।
বাড়ির আঙিনায় খসে পড়েছিল তারা। তারা বলতে নক্ষত্র নয়, উল্কাপিণ্ড। তা নিয়ে রীতিমতো হইচই-ও হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। রাতারাতি গবেষকরা এসে অতি-সন্তর্পণে সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বহু মূল্যবান পাথর। অথচ, সেভাবে কোনো অর্থ প্রদান করা হয়নি সংশ্লিষ্ট পরিবারটিকে।
ব্রিটেনের গ্লোচেস্টারশায়ারের উইঞ্চকম্বের এই ‘তারা খসার’ গল্প বছর খানেক আগে জায়গা করে নিয়েছিল ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেও। এবার আরও একবার সাড়া ফেলল সেই ‘বিখ্যাত’ উল্কা। তার সৌজন্যেই রহস্যোন্মোচন হল পৃথিবীর প্রাচীন ধাঁধাঁর।
দীর্ঘদিন ধরেই গবেষকরা সন্দেহ করেছিলেন, কোনো বহির্জাগতিক গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতুর খসে পড়ার ফলেই পানি পেয়েছিল পৃথিবী। তবে পাকাপাকিভাবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি কোনো।
এবার গ্লোচেস্টারশায়ারে পাওয়া উল্কাপিণ্ডটির রাসায়নিক বিশ্লেষণই সেই উত্তর দিল। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জ্যোতির্বিদ ও ভূবিজ্ঞানীরা জড়িত ছিলেন এই গবেষণার সঙ্গে। সম্প্রতি সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্রটি জানাল, সবমিলিয়ে প্রায় ১১ শতাংশ পানি ছিল ছোট্ট এই ‘এলিয়েন’ পাথরটিতে। ছিল ২ শতাংশ কার্বনের উপস্থিতিও।
গবেষকদের প্রেস রিলিজ অনুযায়ী, উল্কাপিণ্ডে মধ্যে পাওয়া হাইড্রোজেনের বিভিন্ন আইসোটোপের অনুপাত, পৃথিবীর মহাসাগরে প্রাপ্ত পানির প্রোটিয়াম ও ডয়টেরিয়ামের অনুপাতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উল্কাটির এই চরিত্রই আরও বিশেষভাবে প্রমাণ করছে, পৃথিবী পানি পেয়েছিল মহাজাগতিক কোনো বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই।
এখানেই শেষ নয়। সিএম কার্বোনাসিয়াস কনড্রাইট নামে চিহ্নিত করা এই উল্কাপিণ্ডের মধ্যে পাওয়া গেছে অ্যামাইনো অ্যাসিডও। অর্থাৎ, গ্রহাণুর সংঘর্ষে পানি ছাড়াও যে জৈবিক উপাদান পেয়েছিল পৃথিবী, মিলছে তার অস্পষ্ট ইঙ্গিতও।
পাশাপাশি কসমোকেমিস্ট্রির এক অজানা অধ্যায়ও খুলে যেতে পারে এই গবেষণা থেকে, এমনটাই মনে করছেন গবেষকরা।
তবে এটাই তো প্রথম নয়, এর আগেও পৃথিবীর বুকে খসে পড়েছে একাধিক উল্কাপিণ্ড। সে-সব পাথর নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। তবে এই বিশেষ উল্কাটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যকেই কেন প্রাধান্য দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা?
আসলে এই ধরনের মহাজাগতিক পাথর পৃথিবী খসে পড়ার পরই দ্রুত বদলাতে থাকে তাদের চরিত্র। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে পানি শোষণ করায় বদলে যায় তাদের রাসায়নিক গঠনও।
এক্ষেত্রে উল্কাটি ভূপৃষ্ঠে খসে পড়ার কিছুক্ষণ বাদেই সংগ্রহ করা হয়েছিল তা। কাজেই, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেভাবে বদলায়নি তার রাসায়নিক চরিত্র।
বলাই বাহুল্য, প্রাথমিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর নির্ভর করেই প্রকাশ করা হয়েছে সাম্প্রতিক এই গবেষণাপত্রটি। রহস্যময় এই পাথরের চরিত্র বুঝতে আরও দীর্ঘ গবেষণা চলবে বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
এদিকে সাম্প্রতিক আর একটি গবেষণায় পৃথিবীতে পানির সৃষ্টির এই ধারণাকে উলটপালট করে দিয়েছে এক নিমেষে। এবার দেখে নেওয়া যাক সাম্প্রতিক গবেষণায় পৃথিবীতে পানির উৎপত্তি নিয়ে গবেষকরা ঠিক কী মত পোষণ করেছেন।
তাদের দাবি, উল্কাপিণ্ড বা মহাকাশের গ্রহাণুদের মধ্যে সংঘর্ষে নয়, মূলত সৃষ্টি থেকেই পৃথিবীতে পানি রয়েছে। সম্প্রতি লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একদল গবেষকের গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে পিএনএস-এ।
ওই গবেষণা পত্রে দাবি করা হয়েছে, কোটি কোটি বছর আগে থেকে চাঁদের গায়ে লেগে থাকা পাথর থেকেই জানা যাবে পৃথিবীতে পানি সৃষ্টির ইতিহাস। তবে ওই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য রসায়নবিদ গ্রেগ ব্রেনিকা বলেছেন, পৃথিবীতে পানি আগে থেকেই ছিল, উল্কাপাত বা মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহের মধ্যে সংঘর্ষ বা বিচ্ছুরণের মাধ্যমে পানিের সৃষ্টির ধারণা একেবারেই সঠিক নয় বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন ওই গবেষকদল। তারা বলেছেন, পৃথিবীতে পানির উৎপত্তি নিয়ে একাধিক ধারণা রয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই।
এ বিষয়ে বিগত কয়েক দশক আগে গবেষকদের ধারণাকে উল্লেখ করে তারা জানিয়েছেন, আগে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মূলত মহাকাশের উল্কাপিণ্ড এবং পৃথিবীর বাইরের কোনও গ্রহাণু থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাতের মাধ্যমেই পৃথিবীতে পানিের সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে, একেবারে সৃষ্টি থেকেই পৃথিবীতে পানিের অস্তিত্ব রয়েছে। সম্প্রতি গবেষকরা এই ধারণাকে সমর্থন করেছেন বলে জানা গিয়েছে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে।
পাশাপাশি ওই গবেষণা পত্রে দাবি করা হয়েছে, বাইরে থেকে নয়, সৃষ্টি থেকেই পৃথিবীতে পানি ছিল এবং পৃথিবী সৃষ্টির সময় যে বস্তুটির সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতেও পানি ছিল বলে দাবি হয়েছে গবেষণা পত্রে। তবে উল্কাপিণ্ড থেকে পৃথিবীতে পানি আসতে পারে না বলেও দাবি করেছেন গবেষকরা।
এই বিষয়ে ওই গবেষক মহল দাবি করেছেন প্রায় ৪ থেকে ৪.৫ কোটি বছর আগে মহাকাশে সংঘর্ষের ফলে পৃথিবী এবং চাঁদ থেকে অনেক বস্তু অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সংঘর্ষের ফলে মহাকাশের অন্যান্য কিছু গ্রহাণু থেকে ক্রমশ শুষ্ক হয়ে গিয়েছে চাঁদ। পাশাপাশি ওই সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীও শুষ্ক হয়ে যায় বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
এই গবেষণাটি চালাতে গবেষকরা ওই সংঘর্ষের সময় কালের চাঁদের গায়ে লেগে থাকা পাথরের পরীক্ষা করেছেন বলে জানা গিয়েছে। পাশাপাশি গবেষকরা তাদের দাবির সমর্থনে বলেছেন, চাঁদে পৃথিবীর মতো ঋতু ও টেকটনিক পরিবর্তন হয় না। তাই কোটি কোটি বছর আগে থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের গায়ে লেগে থাকা পাথর থেকেই জানা যাবে, পৃথিবীতে পানিের উৎপত্তির ইতিহাস। এই জন্য বিগত কয়েক দশক আগে চাঁদ থেকে নিয়ে আসা পাথর গুলি নিয়ে পরীক্ষার পাশাপাশি সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে, শুধুমাত্র পানির উৎপত্তিই নয়, চাঁদের পাথর পরীক্ষা করলেই পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস সামনে উঠে আসতে পারে। কারণ কোটি কোটি বছর আগে মহাকাশে লাগাতার সংঘর্ষের পরেও চাঁদের পাথরগুলি অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। আগামীতে চাঁদের ওই অপরিবর্তিত পাথর থেকেই পৃথিবীতে পানির উপস্থিতি ও উৎপত্তির ইতিহাস মিলবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১১
আপনার মতামত জানানঃ