কাবা ধ্বংস কিংবা কাবায় হামলা আরব অঞ্চলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। যে উমাইয়াদের হাতে ইসলামের প্রসার ঘটেছে সেই উমাইয়াদের হাতেই প্রথম দুইবার কাবা আক্রান্ত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ইয়াজিদি বাহিনী মদিনার মসজিদে নববীকে ঘোড়ার আস্তাবল বানায় এবং ঘোড়ার মলমূত্রে অপবিত্র হয় মুসলিমদের পবিত্রতম এই স্থান। অন্যদিকে মদীনায় নারীদের ওপর ইয়াজিদ-সেনাদের গণ-ধর্ষণের পরিণতিতে এক হাজারেরও বেশি অবৈধ সন্তান জন্ম নিয়েছিল এবং তাদের বাবা কে ছিল তা সনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। ইতিহাসে এদেরকে ‘হাররা বিদ্রোহের সন্তান’ বলে উল্লেখ করা হয়।
কাবা মুসলিমদের কাছে পবিত্র বস্তু। তবে এই কাবা যখন আক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ পাক মাটির দেবতার মতনই অসহায় থাকেন। কামানের গোলা, কাবায় আগুন, বন্যায় কাবার দেওয়াল ভেঙ্গে পড়া থেকে শুরু করে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যা কাবায় ঘটেনি। জীবন বাঁচাতে কাবা ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার পরও সেই কাবা থেকে বের করে হত্যা করার মতন ঘটনাও ইসলামের ইতিহাসে ঘটেছে।
প্রথম মক্কা অবরোধ (৬৮৩) ও কাবায় আগুন
৬৮৩ সালে দ্বিতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়। এসময় মক্কার প্রধান ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। উমাইয়া খলিফা প্রথম ইয়াজিদের বিপক্ষে সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। মদিনার পর ইসলামের আরেক পবিত্র শহর মক্কা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। উমাইয়া কর্তৃপক্ষ আরবের বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনা প্রেরণ করে। উমাইয়া সেনারা মদিনার লোকদের পরাজিত করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু মক্কা মাসব্যাপী অবরোধের মুখে পড়ে। এসময় কাবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইয়াজিদের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পৌছার পর অবরোধ সমাপ্ত হয়।ইবনে জুবাইর ক্ষতিগ্রস্ত ক্বাবা পুরোটা ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না, এই ভয়ে যে, যে ক্বাবা ভাঙতে এগিয়ে আসবে তাঁর উপর আসমানি গজব পড়বে। একজন সাহস করে একটা পাথর ছুড়ে মারল। কিন্তু তাঁর উপর কোন গজব আসল না। এটা দেখে বাকিরা সাহস পেয়ে ভাঙ্গা শুরু করল। একদম পুরোপুরি মিশিয়ে দেবার পর আবার গোড়া থেকে বানানো শুরু হলো। কালো পাথর টুকরা টুকরা হয়ে যায় এই আক্রমণে। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর একটা রুপার লিগামেন্ট ব্যবহার করে সেগুলো জোড়া লাগান।
দ্বিতীয় মক্কা অবরোধ ৬৯২ ও কাবা ক্ষতিগ্রস্ত
৬৯২ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময় সংঘটিত হয়। তিনি তার সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে বড় আকারের সেনাদলসহ মক্কায় প্রেরণ করে। উমাইয়া খিলাফতের প্রতি বিদ্রোহী আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে দমন করা সেনা পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল। অবরোধ ছিল ভয়াবহ এবং প্রায় ছয় মাস পর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের মৃত্যুর পর অবরোধ সমাপ্ত হয়।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের অন্যতম সফল সেনাপতি ও প্রশাসক। হেজাজের শাসক আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ছিলেন আবদুল মালিকের শক্ত প্রতিপক্ষ। সফল হওয়ার পূর্বে হাজ্জাজকে কয়েকবার মক্কা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাঠানো হয়। ৬৮৯ সালে তাকে একটি বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করার জন্য দামেস্কে ফিরে আসতে হয়। ৬৯০ সালে তিনি ব্যর্থ হন। তবে ৬৯১ সাল উত্তরের বিদ্রোহী গোত্রগুলোকে দমন করা হয় এবং তিনি বসরার গভর্নর মুসাব ইবনে জুবায়েরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এরপর হাজ্জাজ মক্কার আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের দিকে নজর দেন। ৬৯২ সালে তিনি প্রায় ১২,০০০ সিরিয়ান সৈনিক নিয়ে মক্কা অবরোধ করেন। জন্মস্থান তাইফ পর্যন্ত তিনি কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। বিনাযুদ্ধে তিনি তাইফের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং একে মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে প্রথমে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সাথে আলোচনা করা হয় এবং আত্মসমর্পণ করলে তাকে ক্ষমার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়। তবে বিরোধিতা চালু থাকলে অবরোধ আরোপ করা হবে কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই রক্তপাত হবে না। আলোচনা ব্যর্থ হলে হাজ্জাজ ধৈর্য হারিয়ে আবদুল মালিকের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি দেন এবং বলপ্রয়োগ করে মক্কা দখলের অনুমতির আবেদন করেন। আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর মক্কার উপর কেটাপুল্টের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করা শুরু হয়। পরে কাবার কাছে এক লড়াইয়ে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের তার এক সন্তানসহ নিহত। এই আক্রমণের সময় পাথর নিক্ষেপ করে ক্বাবা ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইবের বানানো অতিরিক্ত অংশ ধ্বংস করে কাবার পূর্বের আকৃতি আনা হয়।
কারামাতিয়দের হামলা (৯৩০)
কারামাতিয় সম্প্রদায়ের ধর্ম ছিল একটা মিশ্র ধর্ম। মূল শিয়াদের থেকে সৃষ্ট ইসমাইলি গ্রুপ আর পারস্যের কিছু আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে গড়ে ওঠে এদের ধর্ম। তারা ৮৯৯ সালে পূর্ব আরবে একটি ধর্মীয় স্বাধীন সরকার ঘোষণা করে। এরা আব্বাসিয় খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আব্বাসিয় খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কারামাতিয়রা মনে করতো হজ্জ হলো কুসংস্কার এবং অনৈসলামিক। ৯৩০ সালে হজ্জের সময় মক্কায় হামলা চালিয়ে তারা বহু হাজিকে হত্যা করে তাদের লাশ জমজম কূপে ফেলে দিয়েছিল। জমজমের পানি অপবিত্র হয়েছে বলে তখন মুসলিম দুনিয়ায় রব উঠেছিল। যাওয়ার সময় তারা কাবার কালো পাথর চুরি করে নিয়ে যায়।এর মূল হোতা ছিল তাদের নেতা আবু তাহির। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মক্কা থেকে হজ বাতিল করা। কিন্তু সফল হয়নি। হজ চলতে থাকে কালো পাথর ছাড়াই।
২৩ বছর পর, ৯৫২ সালে আব্বসীয় খলিফা বিশাল টাকা দিয়ে সেই পাথর ফিরিয়ে আনেন। যে কারামাতিয়রা ফিরিয়ে দিয়ে যায়, সে কুফা-র এক মসজিদে শুক্রবার দিন ছুড়ে মেরে যায় পাথরটা বস্তাবন্দী করে। সাথে একটা চিরকুট, “ক্ষমতা দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, ক্ষমতা দেখিয়েই ফেরত দিলাম আমরা।”
এই ছুঁড়ে মারাতে সাত টুকরা হয়ে যায় পাথর। বলা হয়, আবু তাহিরের মৃত্যু হয় শোচনীয়তম, তাঁর দেহ পোকায় খেয়ে নেয় যেই রোগ তাঁর হয়েছিল। একাদশ শতকে ফাতিমিয় খলিফা আল হাকিম এর পাঠানো এক লোক কাবার সামনে এসে কালো পাথর ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর আগেই সে মারা পড়ে।
১৬২৯ সালের মক্কার বন্যা
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ১৬২৯ সালে বন্যা হয়ে যায় মক্কায়, তখন ক্বাবার দেয়াল ধ্বসে যায়। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে কাবা বানানো হয়। ওসমানি সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন মসজিদ পুরাটা সুন্দর করে আবার বানানো হয়।
১৯৭৯ সালে মসজিদ আল-হারাম অবরোধ
১৯৭৯ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে ইসলামী চরমপন্থিরা সৌদি আরবের, মক্কা শহরে অবস্থিত মুসলমানদের পবিত্র স্থান মসজিদ আল-হারাম দখল করে, যা ছিল মূলত সউদ রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করে যে, ‘মাহাদি’র হিসেবে তাদের নেতা চলে এসেছে এবং মুসলমানরা তাকে মেনে চলবে।
এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বকে বিস্মিত করে কারণ হজব্রত পালনরত হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করা হয়। মসজিদের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াইয়ে মারা যায় ২৫৫ জন আর ৫৬০ জন আহত। মিলিটারি থেকে মারা যায় ১২৭ জন আর ৪৫১ জন আহত। এ ঘটনার পুরেই সৌদি রাষ্ট্রে অধিকতর ইসলামী অনুশাসন কায়েম করা হয়।
মসজিদ আল-হারামের খবর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এটাকে ইহুদী নাসারার চক্রান্ত বলে দাবি করেন, “সন্দেহ নেই, এটা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকান ক্রিমিনাল আর আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদিদের ষড়যন্ত্র।” ফলে সারা বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে আমেরিকা-বিদ্বেষ গড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানের ইউ এস এমব্যাসি পুড়িয়ে দেয়া হয়। লিবিয়ার ত্রিপোলিতেও ইউ এস এম্বাসী ভেঙে পুড়িয়ে দেয়।
১৯৮৭ সালের সংঘর্ষ
১৯৮১ সালের ৩১ জুলাই ইরানী শিয়া হাজিদের সাথে সৌদি পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ইসরাইল ও মার্কিন বিরোধী এক সমাবেশকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এতে মোট ৪০২ জন মারা যায়। যাদের মধ্যে ২৭৫ জন ছিল ইরানি হাজি। এর ঘটনার কারণে সৌদি ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেউ কেউ এটিকে সৌদি পুলিশ কর্তৃক হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
এছাড়া প্রতি বছর হজ্জে শয়তানকে পাথর বাড়তে গিয়ে অসংখ্য হাজির মৃত্যু ঘটে। হজ্জ মৃত্যু হওয়া তাই নতুন কিছু নয়। যদিও বিশ্বাসী মন বিশ্বাস করতে চায় পায়ের তলে পড়ে প্রাণ হারালেও মক্কা যেহেতু পবিত্র জায়গা সেহেতু সরাসরি বেহেস্ত লাভ হয়। বর্তমানে মক্কার হজ্জ ছাড়া মুসলিমদের ধর্মীয় আচার শুদ্ধ হয় না। তবে যতদিন মক্কায় ইবনে জুবায়ের রাজত্ব ছিল ততদিন উমাইয়ারা মক্কার বদলে জেরুজালেমে হজ্জ করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। সৌদি রাজ বংশ উপলব্ধি করতে পারছে যে তার অবস্থান আগের মতন শক্ত অবস্থানে নেই। তাই সৌদি প্রশাসন এখন মক্কাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী এক রাজনৈতিক সমীকরণ করতে চাচ্ছে। মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে তারা সারা বিশ্বে ওহাবী আগ্রাসন চালাচ্ছে। যেমনটি চালাচ্ছে ইয়ামেনে। ইমায়েনের বিদ্রোহী গ্রুপ জেদ্দা বিমানবন্দরে রকেট নিক্ষেপ করলে সৌদি প্রশাসন মুসলিমদের অনুভূতিকে পুঁজি করার জন্যে মিডিয়ায় বলে-ইয়েমেনের বিদ্রোহী গ্রুপ মক্কায় রকেট ছুটেছে। মক্কা যতদিন পর্যন্ত ভ্যাটিকান সিটির মতন না হচ্ছে, যতদিন সৌদির কবজা থেকে বের হতে না পারছে ততদিন সৌদি আরব মক্কাকে কব্জা করে মুসলিমদের নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করবে। সৌদি রাজ পরিবার যেহেতু মক্কার রক্ষক ও ভক্ষক সেহেতু সারা পৃথিবীতে মুসলিমদের একটি বড় অংশ সৌদি রাজ প্রশাসনের মানসিক দাসে পরিণত হয়েছে। সৌদি রাজ পরিবার ব্যবসা ভালো বোঝে। তাই তো গত বছর দেখা গেল জার্মানি সিরিয়ার ১০ লক্ষ শরণার্থী গ্রহণ করলেও সৌদি আরব কোন শরণার্থী গ্রহণ করে নাই। তবে জার্মানিতে তারা ২০০ মসজিদ তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। যাতে ওহাবীবাদ প্রসার ও সৌদিতে বারে বারে হজ্জ করতে আসতে মানুষকে উদ্বুগ্ধ করতে সক্ষম হয়। মুসলিমদের অজ্ঞতা ও অন্ধ অনুভূতিকে কব্জা করে সৌদি রাজ পরিবার ক্ষমতার জুয়া খেলে যাবে। মুসলিম সমাজের রেনেসাঁস না আসা পর্যন্ত সৌদি আরবের আগ্রাসনে সহজিয়া মুসলিমসহ উদার ধর্মীয় মতবাদ বিলীন হয়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ