পৃথিবীতে প্রাণ বিকাশের বিজ্ঞান অনুসন্ধান অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু প্রথম প্রাণ কিভাবে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠলো এই বিষয়টি এখনো কুয়াশাময় রহস্যে ঘেরা। প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কিত একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব এখনো উপস্থাপন সম্ভব হয়নি। একগুচ্ছ নিষ্প্রাণ যৌগ থেকে কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয় সেটা এখনো রহস্যময়। শতকোটি বছর পরে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা খুব সহজও নয়।
প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগের পৃথিবী কেমন ছিল সেটা অনুধাবন করাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। বর্তমানে পৃথিবীতে যেসব জৈব অণুসমূহ পাওয়া যায় সেগুলো দিয়েই আমরা প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে প্রাণের উদ্ভবের একটা ধারনা পেতে চেষ্টা করছি।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এধরনের একগুচ্ছ জৈব অণু থেকে কীভাবে প্রাণের উদ্ভব হতে পারে তার একটা মডেল দেখিয়েছেন। জীবকোষে বিদ্যমান এই অণুগুলোকে আণবিক পর্যায়ের মেশিন বা অণুযন্ত্র বলা যায়। এই অণুগুলো এককভাবে তেমন সক্রিয় নয়, কিন্তু যদি আমরা চর্বি জাতীয় বস্তুর সাথে এগুলোকে যুক্ত করি তাহলে সমন্বিতভাবে তা বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই ধরনের রাসায়নিক সক্রিয়তা বেশ আকর্ষণীয় ঘটনা এবং এই ধরনের ঘটনার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব সম্বন্ধে একটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে। শুধু তাই না, এ ধরনের গবেষণা অন্যন্য গ্রহের প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
বিভিন্ন জটিল অণুর পারস্পরিক ক্রিয়ায় তৈরি বিশেষ ধরনের সজ্জা। দন্ডাকার বস্তুগুলোর প্রস্থচ্ছেদ উপরে দেখানো হচ্ছে। উপযুক্ত অণুর (যারা আঠার মতো কাজ করবে) সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে এই অণুগুলো পাশাপাশি নির্দিষ্টভাবে সজ্জিত হয়ে যেতে পারে।
এই ধরনের স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক সক্রিয়তার উপরে গবেষণার জন্য ১৯৮৭ সালে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিলো। তিনজন রসায়নবিদ, ডোনাল্ড জে. ক্র্যাম, জীন ম্যারি লেন এবং চার্লস জে. পেডারসেন দেখিয়েছেন যে কীভাবে বেশকিছু জটিল অণু পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে নিজে নিজেই একটি মেশিনের মত যুক্তহতে পারে এবং নিঁখুতভাবে কাজ করতে পারে। এভাবে যুক্ত হয়ে এই অণুগুলো বিশেষায়িত সব জটিল কাজ করতে পারে। এদেরকে অণুযন্ত্র বলার কারণও হচ্ছে এটি।
একটি মেশিন যেমন অনেক ছোটো ছোট কলকব্জা দিয়ে গঠিত যেগুলো এককভাবে হয়তো কোনো কাজ করতে পারে না, কিন্তু একসাথে এবং বিশেষভাবে পরস্পর যুক্ত হয়ে যখন মেশিন তৈরি করে তখন সুনির্দিষ্ট কাজ করতে পারে। পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিটি জীবকোষ এধরনের অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র আণবিক মেশিন দিয়েই গঠিত। এই সব মেশিনের সম্মিলিত কর্মকান্ডের মাধ্যমেই একটি জীবকোষ পরিচালিত হয়। সম্পূর্ণ জীবদেহ আবার প্রতিটি কোষের সার্বিক কর্মকান্ডের ফসল।
এই গবেষণার ফলাফলে উজ্জীবিত হয়ে রোমা ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্যাসকেল স্ট্যানো এবং তার সহকর্মীবৃন্দ প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে নতুনভাবে গবেষণা শুরু করেন। সহজবোধ্যতার জন্য তারা ৮৩ টি ভিন্ন ধরনের রাসায়নিক যৌগ নিয়ে পানিতে মিশ্রিত করলেন। এই রাসায়নিক যৌগগুলি জীবকোষের অভ্যন্তরে একত্রে কাজ করে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন অণু তৈরি করে। এদের মধ্যে ডিএনএও রয়েছে কেননা, প্রোটিন তৈরির মূল নকশা ডিএনএতেই লিপিবদ্ধ থাকে। এই পরীক্ষায় যেই ডিএনএ-এর অংশ নেওয়া হয়েছিলো তাতে এমন জেনেটিক কোড ছিলো যেটা জীবদেহে সবুজ আলো নিঃসরণের জন্য দায়ী (জোনাকী যেমন সবুজ আলো নিঃসরণ করে থাকে)।
এছাড়া এটাও বলা প্রয়োজন যে, জীবকোষের ভিতরে এই ৮৩ টি পদার্থের অণু একটি নির্দিষ্ট ঘনত্বের মধ্যে থাকে। কাজেই ফলপ্রসু কাজ পেতে হলে এদেরকে একই ধরনের ঘনত্বের এবং পরিবেশের মধ্যেই রাখতে হবে যেন তারা পরষ্পরের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ পায়। তারা যদি লঘু দ্রবণে থাকে তাহলে পরস্পরের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কমে যাবে। অর্থাৎ অণুগুলোর পরিবেশে একটা ‘গাদাগাদি’ অবস্থা তৈরি করা জরুরী। এই কাজের জন্য স্ট্যানো একটি তৈলাক্ত পদার্থ ব্যবহার করেন যা POPC নামে পরিচিত। এই বস্তুটিকে যখন পানিতে ছাড়া হয় তখন তারা পানির সাথে মেশে না বরং খুব ছোটো ছোটো ফোঁটায় liposome তৈরি করে। লাইপোজম গঠনে অনেকটাই কোষের প্লাজমামেমব্রেণের মতোই। এই লাইপোজমকে যখন বিভিন্ন বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত পূর্বে উল্লিখিত জৈব-মিশ্রনে যুক্ত করা হয় তখন তারা কোষের অভ্যন্তরের পরিবেশের মতোই একটি কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে। এরপর মিশ্রিত অণুগুলো এই চর্বির গোলকের মধ্যে ঢুকে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো একই গোলকে এই ৮৩ ধরনের অণুর সবগুলোকে একত্রে পাওয়া একটু কষ্টকর হয়ে যায়।
স্ট্যানো দেখলেন যে প্রতি ১০০০ টি POPC ফোঁটার মধ্যে পাঁচটি ফোঁটায় ৮৩ ধরনের অণুকে একত্রে পাওয়া যায়। তার প্রত্যাশা অনুযায়ী এই পাঁচটি ফোঁটার মধ্যে সবুজ আলো নিঃসরণের প্রোটিন তৈরি হয়; সেগুলো থেকে সবুজ আলো নিঃসৃত হতে থাকে যা মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে খুব সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। তবে স্ট্যানো এবং তাঁর সহকারীবৃন্দ কম্পিউটারে হিসেব করে দেখেছেন যে, POPC ফোঁটার মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ৮৩ টি ভিন্ন ধরনের অণুর সম্ভবণা অত্যন্ত ক্ষীণ; ১০০০ টির মধ্যে পাঁচটিতে এই সমাবেশ ঘটার প্রায় কোনো সম্ভবনাই নেই। এই ঘটনাটি তাঁদের বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে কেন সম্ভবনা ক্ষীণ হওয়া সত্ত্বেও এই ৮৩ ধরনের অণুকে একত্রে পাওয়া যাচ্ছে। এখান থেকেই তাঁরা ভাবছেন যে, হয়তো এই ৮৩ টি অণুর নির্দিষ্ট পরিবেশে নিজেদের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সজ্জিত হওয়ার একটা প্রবণতা আছে, যার ফলে এরা চেষ্টা করে একত্রে সন্নিবেশিত হয়ে প্রোটিন তৈরি করার। এই প্রবণতা যদি সত্যিই থেকে থাকে তাহলে প্রাণের উদ্ভবের সময় কিভাবে বিভিন্ন অণু একত্রে যুক্ত হয়েছিলো সেই সম্বন্ধে একটা উপসংহারে আসা সম্ভব হবে।
স্ট্যানো এর পরীক্ষায় যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবুও তিনি প্রথমবারের মতো দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন অণুযন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা কোষীয় অবস্থা তৈরি হতে পারে শুধু তাই নয়, বরং এই ধরনের কোষীয় অবস্থান সম্ভবত অবশ্যম্ভাবী। এটা নিয়ে আরো গবেষণা হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে এবং মানুষ প্রাণের উদ্ভবের রহস্য অনুধাবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ