উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন এগিয়ে আছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের সেন্টার ফর ফিউচার অব ডেমোক্রেসির এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬২ শতাংশ মানুষই চীনকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে বিশ্বে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছে ৬১ শতাংশ মানুষ। খবর নিউজউইকের।
দুই দেশের মধ্যে ভোটের পার্থক্য মাত্র এক শতাংশ। তবে এই ক্ষুদ্র পার্থক্যকে সামান্য ভাবতে নারাজ বিশ্লেষকরা। বরং বিষয়টিকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে বাড়তে থাকা মেরুকরণের দিকেই ইঙ্গিত করছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমা গণতন্ত্র। এই ভাবধারায় চীন ও রাশিয়াকে বরাবরই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তবে বিগত ১০ বছরে পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশই চীন ও রাশিয়ামুখো হয়ে উঠেছে।
সেন্টার অব ডেমোক্রেসি বিশ্বের প্রায় ৯৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী বসবাসকারী ১৩৭টি দেশে পরিচালিত ৩০টি বৈশ্বিক জরিপের সমন্বয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায় মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাসকারী অপেক্ষাকৃত উন্নত বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের বিরুদ্ধে ও ৮৭ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভাব পোষণ করে।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ চীনের প্রতি ও ৬৬ শতাংশ রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।
গত ১০ বছরে রাশিয়া ও বিশেষত চীন বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশগুলোর প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্ব আরও ঝুঁকেছে।
প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘বিশ্ব এখন দুটো বিপরীত দলে ভাগ হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক জোট এবং রাশিয়া ও চীন কেন্দ্রিক রক্ষণশীল ও স্বৈরাচারী ইউরেশিয়ান ব্লক’।
সেন্টার ফর দ্য ফিউচার অব ডেমোক্রেসির মতে, রাশিয়ার পক্ষে ভোট বেশি পড়েছে এমন দেশগুলোর ১০টির মধ্যে ৭টি দেশই দেখা গেছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট।
অন্যদিকে অংশ নেওয়া তিন-চতুর্থাংশ দেশেই চীনের প্রতি সমর্থন বেশি দেখা গেছে। এসব দেশের অধিকাংশ মানুষই তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চীন যে সমর্থন লাভ করে তার পেছনে অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। ২০১৩ সালে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ হাতে নেয়। বৃহৎ এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন দেশের জ্বালানি অবকাঠামো ও পরিবহন খাতে চীন ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে।
তিন-চতুর্থাংশ দেশেই চীনের প্রতি সমর্থন বেশি দেখা গেছে। এসব দেশের অধিকাংশ মানুষই তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সংশ্লিষ্ট দেশুগুলোতে বসবাসকারী ৪৬০ কোটি মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ চীনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। অন্যদিকে যেসব দেশে এই প্রকল্প নেই সেখানকার মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ বেইজিংকে সমর্থন জানায়।
উন্নত দেশগুলোর সমর্থন হারালেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে বিগত বছরগুলোতে চীনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে পশ্চিমা নাগরিকদের ৪২ শতাংশ চীনকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও এখন তা ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী পশ্চিমা নাগরিকদের সংখ্যা গত ১০ বছরে ৩৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। শুধুমাত্র ইউক্রেন আক্রমণের পরই তা ২১ থেকে ১২ শতাংশে নেমে আসে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ চলা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তরদাতাদের প্রায় ৭৫ শতাংশ, ফ্রাঙ্কোফোন আফ্রিকায় ৬৮ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৬২ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।
মানবাধিকার পরিষদ বিশ্বের শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থা। এর কাজ হলো ভয় বা পক্ষপাত ছাড়া সর্বত্র মানবাধিকার প্রচার করা, লঙ্ঘনের নিন্দা করা।
পরিষদ সম্প্রতি চমৎকার কিছু কাজ করেছে। ২০১১ সালে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়ার জন্য এর তদন্ত কমিশন বছরে বেশ কয়েকবার শ্রমসাধ্য ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুর্ভোগ সম্পর্কে রিপোর্ট করেছে এবং স্পষ্ট করেছে যে, রোহিঙ্গা গণহত্যা ও দমনের জন্য মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীই দায়ী ছিল।
অবশ্যই, ছোট বা বড় যেকোনো দেশই মানবাধিকার পরিষদের এসব পদক্ষেপ পছন্দ করে না। তারা সবাই এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ সফল হয়, আবার কেউ হয় না। এই সপ্তাহে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর তিক্ত হতাশার কাছে চীন সফল হয়েছে।
আগস্টে, অফিস ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে, জাতিসংঘের বিদায়ী মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে লঙ্ঘনের বিষয়ে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। অধিকারকর্মীরা যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এতে নির্বিচারে আটক থেকে শুরু করে জোরপূর্বক শ্রম, নির্যাতন পর্যন্ত ব্যাপক অপব্যবহারের প্রমাণ রয়েছে। অপব্যবহারের পরিমাণ হতে পারে, ব্যাচেলেট বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
এ ধরনের প্রতিবেদনের পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ হল মানবাধিকার পরিষদে বিতর্ক, সংশ্লিষ্ট দেশকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, অথবা এমনকি একটি সম্পূর্ণ তদন্ত কমিশন গঠন করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকরা একটু উৎসাহ দেখিয়ে চীনের বিরুদ্ধে কেবল একটি বিতর্কের আহবান করেছিল। তারা হেরে গেছে।
চীন কঠোর লবিং করেছে। বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে যারা বেইজিংয়ের বিনিয়োগ থেকে উপকৃত হয়েছে তাদের। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ পশ্চিমাদের “রাজনৈতিক কারসাজি”তে ক্লান্ত।
তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলেন, আজ আমরা আছি, আগামীকাল আপনারা হবেন।
যখন ভোট গণনা করা হয়েছিল, মাত্র ১৭টি সদস্য দেশ সমর্থন করেছিল, ১৯টি দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ১১টি ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিল। আফ্রিকার মধ্যে কেবল সোমালিয়াই পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের সমর্থন দিয়েছে। মৌরিতানিয়া থেকে সেনেগাল, আইভরি কোস্ট এবং ক্যামেরুন পর্যন্ত বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশই চীনকে সমর্থন করেছে।
ভোটটি বিশ্বব্যাপী পরাশক্তি হিসাবে চীনের অবস্থানকে তুলে ধরে। চীন অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল জাতিসংঘের ছোট সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ