জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বিশ্ব জুড়েই। তবে ইউরোপে আল্পস পর্বতমালা অঞ্চলের দেশগুলোতে এটি ভিন্না মাত্রা পেয়েছে। উষ্ণায়নের কারণে বাড়তে থাকা বরফ গলা পানি দখল নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এপির প্রতিবেদনে বিষয়টির আদ্যোপ্রান্ত উঠে এসেছে।
বসন্ত ও গরমে কৃষিকাজের জন্য পানি চায় ইতালি। সুইজারল্যান্ড চায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পানি। এ ভাগাভাগির প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পড়বেই।
তিন দশক আগে ১৯৯১ সালে আল্পস অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, পর্যটন ও জীবনযাত্রা নির্ধারণে প্রথমবারের মতো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হাজির হয় মোনাকো, অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া, লিচেনস্টাইন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও সুইজারল্যান্ড।
এরপর দফায় দফায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্মেলন। শেষবার ইতালি ও সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চলে স্থাপিত যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরো বেশি পরিবেশ বান্ধব করার সিদ্ধান্ত হয়। রেলপথ, বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি ও সরকারি পরিবহন প্রাধান্য পায় তখন।
ঊনিশ শতকের চেয়ে আল্পস অঞ্চলের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। তুষারপাত ও পানির নিম্নমুখী প্রবাহ কিংবা জমাটবদ্ধ হওয়া পানি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এখন।
বিশ্বের বহু অঞ্চল পানি সংক্রান্ত দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এতদিন ইউরোপ তুলনামূলকভাবে নাগালের বাইরে থেকেছে। বনভূমিতে দাবানল ও খরার মতো ছোট মৌসুমী আঘাত এসেছে সত্য। তবে কৃষির জন্য পর্যাপ্ত পানি, জলবিদ্যুৎ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।
উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ডকে রীতিমতো ইউরোপের জলাধারের ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় টানাপোড়েনে আছে রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ। ফলে নতুন রূপ নিয়েছে সংকট।
সুইজারল্যান্ড গত সেপ্টেম্বরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ হিসেব প্ল্যান্টের সংখ্যা ৪৫ থেকে দেড় হাজারে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেখানে পাওয়া যাবে অতিরিক্ত ১৫০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ। সুইজারল্যান্ড দেশের ৬০ শতাংশ বিদ্যুতের জন্য পানি ধরে রাখলে তার প্রভাব অন্যান্য দেশে পড়বে।
বিশেষ করে ফ্রান্সের গ্রিনোবল ও এনেসি, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা এবং ইতালির বোলজানোর মতো শিল্পপ্রধান অঞ্চলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতালি ও ফ্রান্স শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে পড়বে। তারাও ফসলের জন্য আল্পসের পানির ওপর নির্ভরশীল।
এক সময় আল্পস অঞ্চলকে পানি সমৃদ্ধ মনে করা হতো। সেই দিন ফুরিয়ে আসতে খুব একটা বেশি দিন নেই। আগামী দশকগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নির্ধারণে আল্পসের এই পানিবন্টন ভূমিকা পালন করবে। যুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে চান না বিশ্লেষকরা।
পানি মূলত আসন্ন বিশ্বের সবথেকে বড় দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, বিশ্বে ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত, যাদের মধ্যে আড়াই কোটিরও বেশি বাংলাদেশি। আর সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সি ১ হাজার ৪০০ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এ তথ্য জানিয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগকে একটি মানবাধিকার ঘোষণা করার পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও ৭৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত এই বিপুলসংখ্যক মানুষের অধিকাংশই দরিদ্র। তারা হয় প্রত্যন্ত এলাকা অথবা শহুরে বস্তির বাসিন্দা। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে হাজারো শিশুর মৃত্যু ঘটছে।
ইউনিসেফের হিসাব মতে, চীনে ১০ কোটি ৮০ লাখ, ভারতে ৯ কোটি ৯০ লাখ, নাইজেরিয়ায় ৬ কোটি ৩০ লাখ, ইথিওপিয়ায় ৪ কোটি ৩০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ, ডি আর কঙ্গোয় ৩ কোটি ৭০ লাখ, বাংলাদেশে ২ কোটি ৬০ লাখ, তাঞ্জানিয়ায় ২ কোটি ২০ লাখ, কেনিয়ায় ১ কোটি ৬০ লাখ এবং পাকিস্তানে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত।
আর এই সুপেয় পানির অভাবে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয় কন্যা শিশু ও নারীদের। সুপেয় পানি সংগ্রহের ৭১ শতাংশ কাজ তাদেরকেই করতে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ