২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে মোট ১৮৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এর মধ্যে শুধু অক্টোবরেই হত্যা করেছে ২৬ জনকে। মঙ্গলবার ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ দাবি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে ৫১ জন গাজা উপত্যকার। আগস্ট মাসে ইসরায়েল সেখানে ব্যাপক হামলা চালালে তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়। এ খবর দিয়েছে মিডল ইস্ট মনিটর।
খবরে বলা হয়, এ বছর মোট ৩৫ শিশু ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছে। এরমধ্যে ১৯ শিশু পশ্চিম তীরের এবং ১৬ শিশু গাজার। মঙ্গলবার নাবলুসে ইসরায়েলি অভিযানে ৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বছর হত্যা করা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ২২ জনের মরদেহই ফেরত দেয়নি ইসরায়েল।
১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল অন্তত ২৫৬ ফিলিস্তিনির মরদেহ আটকে রেখেছে। এছাড়া ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গুম হয়েছে অন্তত ৭৬ ফিলিস্তিনি।
এদিকে, সূত্র মতে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গত ২০ অক্টোবর দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে বিক্ষোভ করছেন ফিলিস্তিনিরা।
আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের ফাতাহ পার্টিসহ পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি সকল প্রধান রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট পালন করছে। বুধবার রাত থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। অস্ত্রধারীসহ শত শত ফিলিস্তিনি তরুণ কয়েকটি ফিলিস্তিনি শহর এবং শরণার্থী ক্যাম্পে মিছিল করেছেন।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলি সেনারা ২০২১ সালে ৩৫৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিক নীরবতার সুযোগ নিয়ে ইহুদিবাদীরা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থা এ রিপোর্ট দিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত এই ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
এ প্রসঙ্গে স্বজনহারা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর সংগঠন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জানিয়েছেন, তারা পুরো ফিলিস্তিনে হত্যাকাণ্ডের সব ঘটনা তদন্ত করেছেন এবং দেখতে পেয়েছেন ৩৫৭ ফিলিস্তিনির সবাই ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের ১৯ শতাংশ নারী। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম সবচেয়ে বেশি নারী ইহুদিবাদী সেনাদের হাতে নিহত হলেন।
এ ছাড়া নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ২২ শতাংশ হচ্ছে শিশু। আন্তর্জাতিক সমাজ নীরব থাকার কারণ ইহুদিবাদীরা হত্যাকাণ্ডে উৎসাহ পাচ্ছেন বলে প্রতিবেনটিতে উল্লেখ করা হয়।
ইসরায়েলের নির্মমতা থেকে রক্ষা পায়নি ফিলিস্তিনি শিশুরাও। প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ইসরায়েলি সেনাদের আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েল একজনের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। এর আগের এক দুঃখজনক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৪ বছর গড়ে প্রতি তিন দিনে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা তাদের কবজায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এতে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি। বিপরীতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের নির্মমতাও যেন ছাপিয়ে গেছে ইসরায়েলের বর্বর কর্মকাণ্ডে; নাৎসিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে নির্বিচার হামলা, সর্বাত্মক অবরোধ–আগ্রাসনে অকাল আর অপঘাত মৃত্যু যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যে ‘নাকবা’ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি ভূমিতে, তার তাণ্ডবশক্তির নিচে মানবিকতার পদদলন আর কত দিন? আর কত দিনই বা তা ‘চুপচাপ’ চেয়ে চেয়ে দেখবে বাকি বিশ্ব? আর কত রক্তমূল্য পরিশোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে?
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩৭
আপনার মতামত জানানঃ