ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষাংশে ইউরোপে চশমার আবির্ভাব ঘটে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন চিত্রকলায় উঠে আসে চশমা। ১৩৫২ সালে আঁকা দুটো চিত্রকর্মে মানুষ চশমা পরছে, তা দেখা যায়। প্রথম চিত্রকর্মটি দেয়ালে আঁকা এবং দ্বিতীয়টি তৈলচিত্র। তৎকালের চশমা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় উইল বা অসিয়তনামায়ও তা তালিকাভুক্ত হতো।
পশ্চিমা সভ্যতার বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে যে চশমা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব তাদের, সত্যিই কি তাই? নাকি তৎকালের অন্যান্য অনেক প্রায়োগিক ক্ষেত্রের মতো আরব এবং মুসলিমরা এদিক দিয়েও পশ্চিমা সভ্যতার চেয়ে এগিয়ে ছিল? পশ্চিমা সভ্যতার সাহিত্য খুঁজে চশমার যেসব প্রাসঙ্গিক উল্লেখ পাওয়া যায়, তা মূলত পৌরাণিক, আবার কিছু পর্যটকদের বিবরণে পূর্ণ।
চশমা উদ্ভাবনের প্রাচীন ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন সৌদি আরবের ইসলামিক স্কলার এবং গবেষক লুতফাল্লাহ গরী। কখন এবং কোথায় চশমার উদ্ভাবন ঘটল— এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটি তদন্ত চালাতে গিয়ে উনি সাহায্য নিয়েছেন বিভিন্ন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক সূত্রের।
সেগুলোর বরাত দিয়ে তিনি দাবি করেছেন যে আধুনিক সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটি উদ্ভাবনের জন্মলগ্নে আরব এবং মুসলিমদের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পশ্চিমা এবং আরবের সূত্রগুলোতে চশমার কী রকম উল্লেখ পাওয়া গেছে, তা পাশাপাশি উপস্থাপন করে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন।
ভূতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, সভ্যতার প্রারম্ভ থেকেই মানুষ স্ফটিক শিলা ব্যবহার করে এসেছে। একই সাথে, মিসরীয় এবং ফিনিশীয়দের মতো বেশ কয়েকটি সভ্যতার মধ্যে প্রাচীনকালে তৈরি কাচের ব্যবহারও লক্ষ করা গেছে। প্রাচীন অনেক সভ্যতায় কাচনির্মিত বিভিন্ন তৈজসপত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
রোম, গ্রিক, ইসলামিক, হেলেনিস্টিক সভ্যতায় লেন্সের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রমাণ এবং বিবরণ থেকে জানা যায় যে এই লেন্স তৎকালে আতশ কাচ হিসেবে ব্যবহৃত হতো না। বরং সূর্যরশ্মির দিকে তাক করে আগুন জ্বালানোতেই এদের প্রয়োগ সীমাবদ্ধ ছিল। এ জন্য তাদের ‘বার্নিং মিরর’ বা জ্বলন্ত আয়না নামে ডাকা হতো। এ বিষয়ে ইসলামিক সভ্যতাগুলো থেকে বেশ কিছু রচনাবলিও পাওয়া গেছে।
বিশ্বের বহু মিউজিয়ামে অনেক পুরোনো লেন্স এখন শোভা পায়, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি সহস্রাব্দ পুরোনো। তবে নমরুদের লেন্স, যেটি ১৮৫০ খিষ্টাব্দে ইরাকের নিনেভ নগরীতে আবিষ্কৃত হয়, সেটিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই লেন্সটি যে স্ফটিক দিয়ে তৈরি, তা খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় ৭০০ বছর পুরোনো। আধা ইঞ্চি ব্যাসের এই লেন্সের এক পাশ সমতল হলেও অন্য পাশ অবতল। বর্তমানে এটি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এটি থেকেই মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় কী ধরনের টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হতো, তার ধারণা পাওয়া যায়। এই বক্তব্যের পেছনে তারা প্রমাণও পেশ করেছেন। মেসোপটেমীয় বিভিন্ন নথিতে তারকারাজির অবস্থানের বিবরণ পাওয়া যায়, আর সেগুলো নিখুঁতের কাছাকাছি। তাই তা অর্জন করতে টেলিস্কোপের এই আদি রূপকে ব্যবহার করা হয়েছে— এমনটাই অভিমত এই ঐতিহাসিকদের। তবে অধিকাংশ গবেষক বিশ্বাস করেন যে কোনো বস্তুকে বড় করে দেখার জন্য নয়; বরং সৌন্দর্যবর্ধনের কাজেই এই কাচটি ব্যবহৃত হতো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইংরেজ স্কলার রজার বেকন আতশ কাচ সম্পর্কে লেখেন এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করে কোনো কিছুকে বড় করে দেখা যায়, তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি সেখানে লিখেন, এই ছোট লেখাকে এই ধরনের কাচ বড় করে তুলতে পারে। তাই বয়োবৃদ্ধ এবং যাদের দৃষ্টিশক্তিতে ত্রুটি আছে, তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী।
অনেক বিজ্ঞানবিষয়ক ঐতিহাসিকই মনে করেন, আল-হাসান ইবনে আল-হাইথামের লিখিত ‘কিতাব আল-মানাজির’ বইটি বেকনের উপযুক্ত অনেকগুলো কথার সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। কারণ, আলোকবিজ্ঞানে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইবনে আল-হাইথামের এই বইটি সে সময় ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, যার নাম ‘বুক অব অপটিকস’। চোখ কীভাবে আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত, তা-ও এখানে এঁকে দেখিয়েছিলেন আল-হাইথাম।
এই পর্যবেক্ষণটি ইতিপূর্বে অন্য কারও রচনায় দেখা যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যেসব নথি-প্রমাণ রয়েছে, তা থেকে দেখা যায় যে রজার বেকনের লেখাতেই প্রথম কাচকে পড়ার কাজে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
অক্ষিবিদ্যার আরেকজন ঐতিহাসিক জার্মান চিকিৎসক জুলিয়াস হার্শবার্গ। তিনি উল্লেখ করেছেন, বইকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পাঠানোর সময় সেগুলোকে যে বাক্সে বন্দী করা হতো, তার সাথেই রংবিহীন বেরিলিয়াম পাথর দিয়ে দেওয়া হতো। অর্থাৎ এই কাচগুলো বিবর্ধকের কাজে ব্যবহৃত হতো এবং ১৩ শতকের প্রারম্ভে এখান থেকেই চশমার আবির্ভাব ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু হার্শবার্গের নিজের বক্তব্যেই মতবিরোধ লক্ষ করা যায়, যখন তিনি নিজেই আরেক জায়গায় বলছেন যে ইবনে আল-হাইথাম ১১ শতক থেকেই বিবর্ধক কাচ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
তাই চশমা ঠিক কার হাতে উদ্ভাবিত হয়েছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকেরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে এমনটাও মনে করেন, চশমা হয়তো স্রেফ একজনের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়নি। বরং বিবর্ধক কাচ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই চশমা বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
খ্যাতনামা আলোকবিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম দ্বারা রজার বেকন প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। তারও আগে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের ভিত গড়ে দেওয়ার অনেকটা কৃতিত্ব আল-কিন্দির। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ইরাকের বসরা নগরীর প্রখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম। তিনি আলোর প্রতিসরণ নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। বর্ণহীন কোনো পৃষ্ঠতল যেমন কাচ, বাতাস বা পানির মধ্যে দিয়ে আলো ভ্রমণ করার সময় তার পথ কীভাবে বেঁকে যায়, তা নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন।
আল-হাইথামের ভাষায়: যখন কোনো বস্তুকে বর্ণহীন কোনো কিছু দিয়ে দেখা হয়, তখন দৃশ্যমান এ বস্তুগুলোর আকৃতি ভিন্ন রকম দেখা যায়। এটা মূলত সেসব বর্ণহীন বস্তুর পৃষ্ঠতলের আকৃতির কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু তার মতে, যেহেতু দৈনন্দিন জীবনে এর বিশেষ কোনো প্রয়োগ নেই, তাই এই বিষয়ে বাড়তি কোনো গবেষণা জরুরি না। আবার একই সাথে নিজের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার পর, তিনি লেখা বৃহদাকার এবং স্পষ্ট করার কাজে উত্তল লেন্স ব্যবহার করতেন।
এ ছাড়া আল-হাইথাম বলেছিলেন, দৃশ্যমান বস্তু যে আমাদের গোচরে আসে, তা মূলত আলোর প্রতিসরণের কারণে ঘটে থাকে। পুরু উপাদান যেমন পানির মধ্যে দিয়ে আলোর এ প্রতিসরণ ঘটে থাকে। তাই বলা যায় যে তিনি বর্ণহীন পৃষ্ঠতলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়া বস্তুর বিবর্ধন সম্পর্কে জ্ঞাত হলেও প্রাত্যহিক জীবনে এই ঘটনাটির অসাধারণ উপযোগিতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তবে লেন্সের ক্ষেত্রে ইবনে আল-হাইথামের রচনাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ইউরোপীয় লেখালেখির অগ্রজও ছিল, অন্তত ৩০০ বছর পুরোনো।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে চশমার ব্যবহার দ্রুতই বাড়তে থাকে। কাব্য-সাহিত্য-ইতিহাসের বই কিংবা চিত্রকলায় বারবার ওঠে আসতে থাকে। ‘তারুণ্যের পর বার্ধক্য আমার কাছে এল। একসময় আমার দৃষ্টিশক্তি ছিল প্রখর, কিন্তু এখন আমার চোখ কাচের তৈরি’। আহমাদ আল-আত্তার আল-মাসরির কবিতার এই পঙ্ক্তি শুনলে মনে হয় যেন উনি চশমার কথাই বলছেন।
অন্যত্র ক্যালিওগ্রাফার শারাফ ইবনে আমির আল-মারদিনিকে নিয়ে ইতিহাসবেত্তা আল-সাখাওয়ি বলছেন, ‘তিনি বেঁচে ছিলেন ১০০ বছরেরও বেশি। ১৪৪৭ সালে মারা যান তিনি। জীবনসায়াহ্নে এসেও তিনি নিজের ইন্দ্রিয়ের গুণ হারিয়ে ফেলেননি এবং আয়না ছাড়াই সুন্দর লিখতেও পারতেন।’ এখানে ‘আয়না’ শব্দটি দিয়ে হয়তো চশমার কাচকেই বোঝানো হয়েছে।
চক্ষুবিদ্যার ইতিহাস সম্পর্কে জুলিয়াস হার্শবার্গ বলেছেন, মুসলিম চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞেরা নিজেদের বইপত্রে চশমার উল্লেখ করেছেন। তবে চশমা যে মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতাকে ঘোচাতে পারে, চশমার এত বড় একটি উপযোগিতার দিকটিকে ইউরোপীয় চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞেরা উপেক্ষা করে গেছেন। এমনও হতে পারে যে মুসলিম বিশ্বে চশমা তত দিনে বেশ প্রচলিত।
পাশাপাশি ইউরোপীয় চিত্রশিল্পে চশমার উপস্থিতি অনেক বেশি পাওয়া গেলেও শুরুর দিককার ইসলামিক চিত্রকর্মে চশমা দেখতে পাওয়া যায় না। এর কারণ এমনও হতে পারে যে যেহেতু ইসলামে মানুষ বা প্রাণীর অবয়ব আঁকার ক্ষেত্রে বারণ আছে, তাই সেখানে মানুষের চোখে চশমা দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো যে ছবিটিতে একজন ব্যক্তিকে চশমা পরিহিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো পারস্যের শিল্পী রিধা আল-আব্বাসির একটি প্রতিকৃতি (১৬৩৫)। বার্ধক্যে ওনারই শিষ্য মু’ইন আল-মুসাওয়ের এটি আঁকেন। ছবিটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে।
সত্যি বলতে, প্রমাণের অপ্রতুলতা এবং বানোয়াট গল্পের কারণে চশমা উদ্ভাবনের আদি ইতিহাস পূর্ণতা পায় না। পক্ষান্তরে, বর্ণহীন বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে আলোর প্রতিসরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম। যদিও তিনি এর কোনো সরাসরি প্রাত্যহিক উপযোগিতা পাননি, কিন্তু তার রচনাবলিকে ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে চশমার উদ্ভাবন ঘটেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৭
আপনার মতামত জানানঃ