সুইডেনের সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৭ শতকের আইকনিক যুদ্ধজাহাজ “ভাসা” এর হারিয়ে যাওয়া আরেকটি জাহাজ আবিষ্কার করেছেন। কোম্পানির জাহাজগুলো প্রায় একই রকম হওয়া তাদের বোন বলে অভিহিত করা হত। হারিয়ে যাওয়া জাহাজটি তার প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ডুবে গিয়েছিল। সোমবার সুইডিশ মিউজিয়াম অফ রেক্স জানিয়েছে। খবর ডনের
জানা যায়, ১৬২৯ সালে চালু করা “অ্যাপলেট” (দ্য অ্যাপল) এর জাহাজ নির্মাতা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত ৬৯-মিটার (২২৫-ফুট) “ভাসা”, যা ১৯৬০ এর দশকে উদ্ধারের পর স্টকহোমে প্রদর্শন করা হয়।
জাদুঘরের সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক জিম হ্যানসন বলেন, যখন আমরা ধ্বংসাবশেষটি “ভাসা’র সাথে কতটা মিল ছিল তা দেখছিলাম, আমাদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
জাদুঘর অনুসারে, রাজধানী স্টকহোমের ঠিক বাইরে ভ্যাক্সহোম দ্বীপের একটি প্রণালীতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিশাল জাহাজের এ ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
হ্যানসন বলেন, জাহাজটির নির্মাণ এবং এর মাত্রা তাদের কাছে খুব পরিচিত বলে মনে হয়েছিল। আশা জাগিয়েছিল যে, এটি ভাসার বোন জাহাজগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে।
২০২২ সালে ধ্বংসাবশেষের আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ জরিপ করা হয়েছিল। জরিপ জাহাজের যে বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেছে তা আগে শুধুমাত্র ভাসাতে দেখা গিয়েছিল।
জাদুঘরটি বলেছে, প্রযুক্তিগত বিবরণের পাশাপাশি পরিমাপ এবং কাঠের নমুনাগুলি নিশ্চিত করেছে যে এটি “প্রকৃতপক্ষে অ্যাপলেট, ভাসার বোন জাহাজ।” ২০১৯ সালে, একই জাদুঘর একই এলাকায় আরও দুটি যুদ্ধজাহাজের আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে।
যখন আমরা ধ্বংসাবশেষটি “ভাসা’র সাথে কতটা মিল ছিল তা দেখছিলাম, আমাদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেছিলেন, তাদের মধ্যে একটি অ্যাপলেট হতে পারে। কিন্তু আরও তদন্তে দেখা গেছে, জাহাজগুলো পরিবর্তীত ১৬৪৮ সালের দুটি মাঝারি আকারের যুদ্ধজাহাজ ছিল – যার নাম “অ্যাপোলো” এবং “মারিয়া”।
হ্যানসন বলেন, অ্যাপলেট’ এর সাথে, আমরা সুইডিশ জাহাজ নির্মাণের উন্নয়নে ধাঁধার আরেকটি মূল অংশ যোগ করতে পারি। এটি গবেষকদের অ্যাপলেট এবং ভাসার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সাহায্য করেছে।
যেভাবে ‘ভাসা’র সন্ধান মেলে
জানা যায়, সতেরো শতকে পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া আর সুইডেনের মধ্যে বিরাজ করছিল তীব্র রেষারেষি। সুইডেনের তৎকালীন রাজা, উত্তরের সিংহ হিসেবে পরিচিত গুস্তাভাস দ্বিতীয় অ্যাডোলফ চিন্তা করে দেখলেন বাল্টিক সাগরে নিজেদের একটা শক্তিশালী নৌ অবস্থান তৈরি না করলে নয়। ইতিমধ্যেই কিছু যুদ্ধে পোলিশদের হাতে পড়ে হারাতে হয়েছে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আদেশ দিলেন, তৈরি করতে হবে দুর্ধর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য এক যুদ্ধজাহাজ!
আদেশ দেওয়া হয়েছিল ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে, আর ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দেই তৈরি হয়ে যায় ৬৯ মিটার দীর্ঘ, ৫০ মিটার উচ্চতার আর ১২০০ টন ভরের এক দুর্দান্ত যুদ্ধজাহাজ। বসানো হয় ৬৪টি কামান আর শয়ে শয়ে ভাস্কর্য, যেন অবয়বেই পিলে চমকে যায় শত্রুদের। দৈত্যাকার এ জাহাজের নাম দেয়া হলো ‘ভাসা’ (Vasa)!
১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ১০ আগস্ট। স্টকহোম শহরের হাজারো অধিবাসী আর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ভিড় করেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। ‘ভাসা’র প্রথম যাত্রা দেখবেন তারা। ইতিহাসের সাক্ষী তারা হয়েছিলেন বটে, প্রথম যাত্রায় শিপইয়ার্ড থেকে মাত্র ১৩০০ মিটার দূরেই যে ভরাডুবি ঘটে আশা-ভরসার প্রতীক এই যুদ্ধজাহাজের!
জাহাজডুবির পর কেটে গিয়েছিল ৩০০ বছরের বেশি সময়। আন্দেস ফ্রাঁজিয়া নামের এক জ্বালানি প্রকৌশলী বেকহলমেন দ্বীপের সামনে পানির নিচে কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পেলেন ওক কাঠের একটি খণ্ড। আরেকবার অনুসন্ধানে আবার খুঁজে পেলেন একই জিনিস। পানির নিচের ওই এলাকায় তবে খুব বড় কিছু আছে, কিন্তু সেটা কী? এটাই সেই বিখ্যাত ‘ভাসা’ নয়তো?
নেভি অভিযান শুরু করল। দ্রুতই আবিষ্কৃত হলো যুদ্ধজাহাজের ভগ্নাবশেষ। কিন্তু এত বছর ধরে পানির নিচে ছিল, শীতল পরিবেশ—এসবই কাঠ পচানো কীটদের পক্ষে অনুকূল; তবে এখন পচে-গলে কিছু কি বাকি আছে জাহাজের? নিয়তিই বটে! জানা গেল, সুয়েজ আবর্জনা নাকি ঘিরে ছিল তাকে, আর তাই এখনো অবশিষ্ট আছে একসময়ের প্রতাপশালী এই জাহাজ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ