গ্যাস–সংকটের কারণে বস্ত্র খাতের ৯০ শতাংশ কারখানাই এখন ভুগছে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় কারখানাগুলো দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে তাদের উৎপাদন–ক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
গত মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী।
দ্রুত সমস্যার সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারাবেন। দেশের ব্যাংকগুলোও পুঁজি হারাতে পারে।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী। গ্যাস–সংকট কাটাতে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি। সেই সূত্র ধরে সংবাদ সম্মেলনের পর জানতে চাইলে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পেলে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ছয় টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ দিতে বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা রাজি আছেন বলে মন্তব্য করেন বিটিএমএ সভাপতি।
বর্তমানে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা। বস্ত্র খাতের কয়েক শ কারখানা গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ সহসভাপতি ফজলুল হক ও আবদুল্লাহ আল মামুন, পরিচালক মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লাহ জোবায়ের ও সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রমুখ।
বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা, শিল্পকারখানাসহ দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কয়েক মাস আগেও আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ (এলএনজি) পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৬০ কোটি ঘনফুটের কিছুটা বেশি।
সাড়ে তিন মাস ধরে চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে পেট্রোবাংলা। তবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আসছে।
গ্যাস–সংকট কাটাতে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, দিনে ৩০০ কোটি ঘনফুটের কাছাকাছি গ্যাস সরবরাহ করতে পারলেই সংকট কেটে যেত। পেট্রোবাংলা দেশীয় কূপ থেকে দিনে ২৩০ ঘনফুট দিতে পারছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৫০ কোটি ঘনফুট আসার কথা থাকলে পাওয়া যাচ্ছে ৩৬ কোটি ঘনফুট।
এমন পরিস্থিতিতে যদি খোলাবাজার থেকে প্রতি ১০ লাখ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট ২৫ ডলার দরে ২০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হয়, তাহলে দেশে প্রতি ঘনফুটের দাম দাঁড়াবে ৮৮ টাকা ২৮ পয়সা। দেশীয় কূপের গ্যাসের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও খোলাবাজার থেকে আমদানি করা এলএনজি মিশ্রণ করে গ্রাহকদের সরবরাহ করলে সম্মিলিতভাবে প্রতি ঘনফুটের গড় দাম হবে ২১ টাকা ৩৬ পয়সা।
খোলাবাজার থেকে ২০ কোটির পরিবর্তে ৪০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হলে দেশে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের গড় দাম দাঁড়াবে ২৫ টাকা ৭৪ পয়সা। আর দিনে ৪০ কোটি ঘনফুট করে সরবরাহ করতে হলে মাসে খরচ হবে ৩০ কোটি ডলার।
এমন তথ্য দিয়ে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ক্যাপটিভ জেনারেটরভিত্তিক বস্ত্রকলগুলো বছরে ১৬ হাজার ৯১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে। এর বিপরীতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিল পরিশোধ করে তারা।
প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে এ খরচ বেড়ে আড়াই ডলারে পৌঁছেছে বলে জানান মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, গত মার্চ মাস থেকে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস–সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে।
সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের আশ্বাস মিলছে জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, পেট্রোবাংলা আশ্বস্ত করেছিল, চলতি মাসের শুরু থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। নভেম্বরে পরিস্থিতি আরও ভালো থাকবে। ডিসেম্বরে সংকট কেটে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি তো দূরের কথা, আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মূল বাজারে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। তাতে গত কয়েক মাসে বস্ত্রকলগুলোর ১০০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, অনেকে বলতে পারেন, ক্রয়াদেশ কম থাকার পরও গ্যাস–সংকট নিয়ে আমরা কেন উচ্চবাচ্য করছি।
আসলে ক্রয়াদেশ কমবেশি যা–ই থাকুক না কেন, বস্ত্রকলে সারা বছরই উৎপাদন করতে হয়। দেশে করোনার শুরুতে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল হলেও আমরা উৎপাদন চালিয়ে গেছি। সে জন্যই যখন ক্রয়াদেশের বাড়তি চাপ এসেছে, তখন আমরা ব্যবসা ধরতে পেরেছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৯
আপনার মতামত জানানঃ