কাজী ফয়সাল : যশোরের দুঃখের নাম ভবদহ বিল। তিন দশক ধরে জলাবদ্ধতায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে এ অঞ্চলের কৃষি এবং কৃষকের। তবে এবার পতিত জমিতে আবাদের লক্ষ্যে কৃষকরা নিজ উদ্যোগেই পানি নিষ্কাশন শুরু করেছেন। ২২ টি সেচ পাম্প দিয়ে চলছে পানি নিষ্কাশনের কাজ। বিলকপালিয়া এবং আড়পাতা বিলের পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে তিন দশক পরে এ অঞ্চলের ৫০ হাজার কৃষক আবাদে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন।
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চলের বিস্তৃতি। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে নির্মিত হয় ভবদহ স্লুইজগেট। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে তৈরি স্লুইজগেটটি এই অঞ্চলের ১০ লক্ষ মানুষের জন্য ‘অভিশাপে’ পরিণত হয়েছে। কারণে অকারণে এ সুইচ গেটটি আজ মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভবদহবাসীর কাছে। বন্যা, জলাবদ্ধতা ৩৩০ কিমি. ধরে বিস্তৃত এলাকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গীতে পরিনত হয়েছে।
ভবদহ স্লুইজগেট দিয়ে ২৭টি বিলের পানি পার হয়। স্লুইজগেটের ২১টি কপাটের মধ্যে ১৮টি বন্ধ হয়ে গেছে পলি পড়ে। এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম হল মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীগুলো। কিন্তু পলি পড়ে নদীগুলো নাব্যতা সংকটে ভুগছে, বন্ধ হয়ে গেছে পানি চলাচল।
বিভিন্ন সময়ে ভবদহের পানি নিষ্কাশনের দাবিতে আন্দোলন সমাবেশ হলেও সমাধান আসে নি। এ বছরের অক্টোবরেও বিলের পানিতে নেমে মানববন্ধন করেছে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ দায়-দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্তই কাজের পরিধি আবদ্ধ ছিল।
চলতি বছরে বিলকপালিয়া ও আড়পাতা বিলের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসন এবং বোরো আবাদের লক্ষ্য নিয়ে বিলকপালিয়া পানি নিষ্কাশন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে নেহালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. রুহুল আমিনকে সভাপতি এবং বালিধা গ্রামের আফজালকে হোসেনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ কমিটি দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন পরিকল্পনা করে সেচপাম্প (স্যালো মেশিন) দিয়ে বিলের পানি অপসারণের কাজ শুরু করেছে। কপালিয়া ত্রিভেন্ড এলাকায় ২২টি সেচপাম্প বসিয়ে বিলের পানি অপসারণ করে ভবদহ নদীতে ফেলা হচ্ছে।
সেচ কমিটি জানিয়েছে, “১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিএডিসিকে দেয়ার পর তারা ১০টি মেশিন সরবরাহ করেছে। আর নিজেদের অর্থায়নে ১২টি মেশিন চালানো হচ্ছে।“
স্থানীয় কপালিয়া গ্রামের কৃষক সিদ্দিকুর রহমান সরদার, অভয়নগরের কালিশাকুল গ্রামের নারায়ন চন্দ্র সরকার বলেন, “আমরা স্থানীয় কৃষক মিলে নিজেদের অর্থে বিলের পানি অপসারণের কার্যক্রম শুরু করেছি। বিএডিসি তাদের সেচ মেশিন ভাড়া খাটাচ্ছে মাত্র। এ ব্যাপারে বিএডিসি যশোরের তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বিএডিসি নামমাত্র মূল্যে আপাতত এক বছরের জন্য ভাড়া হিসেবে মেশিনগুলো দেয়া হয়েছে। এতে প্রতিটি মেশিনের বাৎসরিক ভাড়া ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিটি মেশিনের বিপরীতে জামানত হিসেবে ৭ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে।“
সেচ কমিটির উদ্যোক্তা শাহিন হোসেন বলেন, “অভিশপ্ত ভবদহের কারণে তিন দশকের অধিক সময় এ দুটি বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে জমির মালিকরা কোনো ফসল করতে পারেন না। ফলে নিরুপায় জনগণ দীর্ঘদিন কষ্টে জীবনযাপন করছে পরিবার-পরিজন নিয়ে। তাই এবার বোরো আবাদ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি অপেক্ষা না করে ভিন্নপথ হিসেবে নিজেদের অর্থায়নে বিলের পানি অপসারণ করে বোরো আবাদে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এ দুই বিলের মালিকদের কাছ থেকে পানি সেচ বাবদ ১ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে।“
পানি নিষ্কাশন কমিটির সভাপতি মো. রুহুল আমিন জানান, “গত এক সপ্তাহ সেচ কার্যক্রম চালানোর পর উভয় বিলের পানি প্রায় ১ ফুট কমেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সেচ কার্যক্রম এভাবে অব্যাহত থাকলে মাঘ মাসের মধ্যে চাষীরা তাদের জমিতে বোরো রোপণ করতে পারবেন।“
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার এই বিষয়ে বলেন, “বিলের পানি সেচের ব্যাপারে আমি বেশি কিছু জানি না। বিষয়টি জানতে বিএডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।“
আপনার মতামত জানানঃ