ফরাসি জ্যোতিষী নস্ত্রাদামুস ভবিষ্যদ্বাণী করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার অনেক ভবিষ্যদ্বাণী এর আগে ফলে গিয়ে সাড়া ফেলেছিল। ১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন নস্ত্রাদামুস। খবর দ্য গার্ডিয়ানের
৪৫০ বছর আগে করা ওই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়নি বটে। তবে সেই বাণীতে ভয় পেয়ে নস্ত্রাদামুস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলেকজান্ডার টলম্যান অস্ট্রিয়ায় তার বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
নস্ত্রাদামুসের পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্বাভাস ব্যর্থ হওয়ায় যারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, অথবা যারা ভাবছেন ২০২২ সবচেয়ে খারাপ বছর গেছে, তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হবে। নস্ত্রাদামুসের ভবিতব্য অনুযায়ী আগামী বছর ইউরোপে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটবে। নস্ত্রাদামুসের ভাষায়: ‘সাত মাসের মহাযুদ্ধে, পাপের ভারে মৃত সবে…।’ অনেকে এটিকে ইউক্রেন যুদ্ধ বেড়ে গিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
পাশাপাশি নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যৎবানীতে আছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কথাও। ১৫৫৫ সালের বইয়েই লেখা আছে, ক্রমে পৃথিবীর সমুদ্র অর্থাৎ জলভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। সে কথা যেন ফলেও গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। পাশাপাশি বেড়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার পরিমাণ, গলতে শুরু করেছে হাজার বছর থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী দুই মেরুর বরফও। এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা চলছে বিজ্ঞানী মহলে। এই পরিবেশ কেন্দ্রীক বিপদের কথা অনেকদিন আগেই প্রকাশ করেছিলেন নস্ত্রাদামুস।
জীবিত থাকতে বিস্তর উপহাসের শিকার হয়েছিল এ ভবিষ্যদবক্তা। তাকে ডাকা হতো ‘একজন নির্বোধ ও খ্যাপা লোক’ হিসেবে। ১৫৪৭ সাল থেকে ১৫৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৯৪২টি ছন্দময় চতুষ্পদী শ্লোক রচনা করেছিলেন। জায়ফল খেয়ে সেক্রেটারিকে দিয়ে এ পদগুলো লেখাতেন তিনি। জায়ফল এমন একটি বস্তু যা অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে মানুষের হ্যালুসিনেশন হয়।
১৫৫৫ সালে প্রকাশিত ‘লো প্রফেটিজ’ গ্রন্থে নস্ত্রাদামুস রাজা প্রথম চার্লসের মৃত্যুদণ্ড, লন্ডনের গ্রেট ফায়ার, ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়ন ও হিটলারের উত্থান ও পতন, জন এফ কেনেডি হত্যা, বেনজির ভুট্টোর গুপ্তহত্যা, নয়-এগার হামলা, ২০১৫ সালে প্যারিসের মাস-মার্ডার, এমনকি ইংল্যান্ডের বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের সিংহাসন ত্যাগ বিষয়ে ভবিষ্যদবাণী করেছেন বলে দাবি করা হয়।
মিশেল দে নস্ত্রাদেম হিসেবে ১৫০৩ সালে ফ্রান্সের সেইন্ত-রেমি-দে-প্রোভেন্সে জন্মগ্রহণ করেন এ ভবিষ্যতদ্রষ্টা। প্রাথমিক জীবনে তিনি প্লেগ রোগের ভ্রাম্যমাণ ঔষধ বিক্রেতা হিসেবে জীবিকানির্বাহ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক ড্যান জোন্স মনে করেন, নস্ত্রাদামুসের সময় আর আমাদের বর্তমান সময়ের মিল রয়েছে। ‘তখন নতুন করে আবিষ্কার হওয়া ছাপাখানার মাধ্যমে ভালো আইডিয়া ও ভুলভাল ধারণা; দুটোই অনায়াসে ছড়ানো যেত। এই ছাপাখানা ছিল তখনকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।’
ছাপাখানার এ সুবিধার সদ্ব্যবহার করলেন নস্ত্রাদামুস। ১৫৫০ সালের পর থেকে তিনি ভবিষ্যদবাণীপূর্ণ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার খ্যাতি বৃদ্ধি পেলে নস্ত্রাদামুস ফ্রান্সের রানি ক্যাথেরিন দো মেডিসি’র সান্নিধ্যে আসেন।
রানির স্বামী দ্বিতীয় হেনরি’র মৃত্যুর ভবিষ্যদবাণীও করেছিলেন নস্ত্রাদামুস। এক অশ্ব-দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীর বর্শা রাজা হেনরির উষ্ণীষ ভেদ করে চোখ, গলা, ও কপালে ঢুকে যায়। এর ১১ দিন পরে আহত রাজার মৃত্যু হয়। ঠিক এরকম মৃত্যুর পূর্বাভাসই দিয়েছিলেন নস্ত্রাদামুস।
১৫৬৬ সালে নস্ত্রাদামুস নিজের মৃত্যুর কথা আগাম জানিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়। এখানে মনে রাখা ভালো, নিজের মৃত্যুর কেবল একদিন আগে তিনি বলেছিলেন পরদিন তার মৃত্যু হবে। আর ততদিনে গেঁটেবাতসহ আরও কিছু বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি বিছানায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাই এটাকে তার জ্যোতিষবিদ্যার গণনা হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণ করা যায় না। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।
তবে নস্ত্রাদামুসের লেখার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, চাইলেই এটিকে নিজের মতো করে পড়া যায়। তিনি এমনভাবে তার শ্লোকগুলো লিখেছেন, সেগুলোর অর্থ নানাভাবে বের করা সম্ভব। শ্লোকগুলোর প্রত্যক্ষ অর্থদ্যোতনা এড়ানো বা দ্ব্যর্থবোধকতা সৃষ্টির জন্য নস্ত্রাদামুস তার লেখায় লাতিন শব্দ ব্যবহার করতেন এবং পদান্বয়ী অব্যয়, সংযোজক অব্যয়, আর্টিকেল ইত্যাদি পরিহার করতেন।
ড্যান জোন্স মনে করেন, ‘তখনকার সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। কিন্তু তারা যেসব তৈরি করেছিলেন, আজকালকার সোশ্যাল মিডিয়া এরকম জিনিসের ওপরই চলে। আদতে, সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে নস্ত্রাদামুস ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।’
আসন্ন দুর্যোগ নিয়ে নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদবাণীগুলো এখনও বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছিলেন, ‘মানুষ মানুষকে খাবে’ কারণ ‘গমের বুশেল অনেক উঁচুতে উঠে যাবে’। এটাকে অনেকে ইউক্রেনের গম রপ্তানিতে বাধার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। যদিও এটা স্রেফ একটা অনুসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে, তবে এর জন্য ক্যানিবালিজম একটু বেশিই বাড়বাড়ি হয়ে যায়।
‘৪০ বছর ধরে রংধনু দেখা যাবে না। শুষ্ক মাটি আরও শুকিয়ে যাবে, এবং যখন (রংধনু) দেখা যাবে, তখন হবে মহাবন্যা।’ নস্ত্রাদামুসের এ ভবিষ্যদ্বাণীকে অনেকে মনে করেন জলবায়ু সংকটের পূর্বাভাস।
নস্ত্রাদামুসের আরেকটি ভবিষ্যদবাণী দিয়ে শেষ করা যাক। তিনি লিখেছেন, ‘দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আবার সংঘবদ্ধ হবে/ বেশিরভাগ মিলিত হবে মঙ্গলের সঙ্গে/ আফ্রিকান নেতা ভয় পেয়ে কাঁপছে/যুদ্ধজাহাজের মুখে পতন ঘটল দুজনের মিত্রতার।’ নস্ত্রাদামুস বিশেষজ্ঞ মারিও রিডিং মনে করেন, এর মানে হচ্ছে ভবিষ্যতে কোনো বৈশ্বিক যুদ্ধে লড়ার জন্য ‘দুই পরাশক্তিকে একত্রিত হতে’ দেখবে বিশ্ব।
তবে রিডিংয়ের ছেলে লরিং এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, আফ্রিকান নেতা বলতে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া ইলন মাস্ক ও তার মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের আকাঙ্ক্ষাকে বোঝানো হচ্ছে। তবে এখানে একটু ‘দুঃসংবাদ’ আছে। কারণ নস্ত্রাদামুস আরও বলেছেন, ‘মঙ্গলের আলো নিভে যাবে।’ তার মানে ইলন মাস্কের আর মঙ্গলে বাস করার ইচ্ছে পূরণ হবে না, বরং তাকে আমাদের মাঝে থেকে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া দেখতে হবে।
এসডব্লিউএসএস১০২০
আপনার মতামত জানানঃ