ম্যারিলিন মনরোর মতো অভিনেত্রীদের আবশ্যকীয় ফ্যাশনসঙ্গী হাই হিল। এই জুতো প্রসঙ্গে মনরো বলেছিলেন, “আমি জানি না কে হাই হিল আবিষ্কার করেছিলেন, তবে তার কাছে মেয়েদের ঋণ অনেক।”
পা জোড়া লম্বা দেখাতে, কর্মক্ষেত্রে পেশাদার বা আত্মবিশ্বাসী হতে, খুব প্রিয় পোশাকের মানানসই সঙ্গী হিসেবে অথবা, যৌন আবেদন সৃষ্টির জন্য মেয়েরা উঁচু হিলের জুতো পরেন। আজকের পৃথিবীতে হাই হিল জুতো নারীত্ব, যৌনতা, আভিজাত্য, শহুরেপনা, ফ্যাশন এমনকি, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আপনি কী জানেন, কয়েকশ বছর আগেই এই হাই হিল ছিল পুরুষের জুতো? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই হাই হিলের যাত্রা শুরু ছেলেদের পায়ে। তাও হয়তো ফ্যাশন হিসেবে নয়, নিতান্ত প্রয়োজন থেকে। সেই প্রাচীন কালে মিশরের কসাইরা উঁচু জুতা পরতো, পায়ে যেন রক্ত না লাগে, সেজন্যে।
তারপর হাই হিল জুতোর গায়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগে মধ্য এশিয়ার বর্তমানের ইরান বা পারস্য সাম্রাজ্যে। ঘোড়ায় বসে সৈন্যরা যেন রেকাবে পা দুটো ঠিকমতো ঝুলিয়ে রাখতে পারে, তাই তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এক ধরনের উঁচু জুতো। এই জুতাগুলো শুধু পায়ে আরামই দিত না, বরং অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়েও দাঁড়িয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিলো, আপনার পায়ে ওই উঁচু জুতোটি থাকা মানে আপনি একজন ঘোড়ার মালিক, এমনকি শক্তিশালী যোদ্ধাও বটে।
পনেরো শতকের শেষ দিকে পারস্যসম্রাট আব্বাস তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অটোমান সম্রাটকে হারানোর জন্য সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠান পশ্চিম ইউরোপে। ধারণা করা হয়, তাদের পায়ে ছিল এই উঁচু হিলের জুতো। ষোলো শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ছেলেরাই হিল জুতা পরতো, যদিও শোনা যায় রানী প্রথম এলিজাবেথের জামাকাপড়ের সাথে একজোড়া হিলওয়ালা জুতো পাওয়া গেছে। আর ওদিকে প্রাচীন রোম ও গ্রিক সাম্রাজ্যের মঞ্চ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং মধ্যযুগে ভেনিসের যৌনকর্মীদের মধ্যেও নাকি ছিল এই হিলজুতো পরার প্রচলন।
তবে এই হিলের জুতাকে প্রথম সিংহাসনে চড়ালেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই। দৈহিক উচ্চতা নিয়ে মনে অনেক দুঃখ ছিল রাজা বাহাদুরের। একটু লম্বা হওয়ার আশায় নিজের ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার সাথে যোগ করলেন আরো ৪ ইঞ্চি উঁচু জুতা, যার তলায় ছিলো লাল টুকটুকে কাঠের গোড়ালি। এরপর সবাই রাজার মত উঁচু জুতা পরতে চাইলো, কিন্তু রাজা তো সবাইকে তার কাতারে আসতে দেবেন না। তাই তিনি শুধু রাজদরবারের অভিজাতদের এই হিল পরার অনুমতি দিলেন। কিন্তু সেই হিল কোনভাবেই রাজামশাইয়ের হিলের চেয়ে উঁচু হতে পারবে না, উঁচু হলেই গুনতে হতো জরিমানা।
১৬ শতকের শুরুতে ইউরোপে লাগে নতুন হওয়া। এনলাইটেনমেন্ট যুগের পুরুষেরা তখন যুক্তি আর বাস্তবতা নিয়ে মহাচিন্তিত। বিলাসিতা এবং ফ্যাশনের পরিবর্তে তারা সবকিছুতে ব্যবহারিক সুবিধার দিকটায় প্রাধান্য দিতে শুরু করলো। গয়নাগাটি পরা বাদ দিলো, কাপড়চোপড় থেকে অনর্থক বাহাদুরি ছেঁটে ফেললো, সেই সাথে তাদের হাই হিল পরাও বাদ পড়ল।
আর এসময়ের দিকেই নারীরা এই হাই হিল লুফে নিলো তখনকার ফ্যাশন এবং আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। ফ্যাশনের এই অদলবদল ঘটে সে সময়ে যখন ভাবা হতো মেয়েরা খুব ভাবপ্রবণ, আবেগী ও বোকা, আর পুরুষেরা কর্মদক্ষ, বুদ্ধিমান, এবং যৌক্তিকতার সার্থক প্রতিনিধি।
এর পরে হাই হিলের ফ্যাশন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি পশ্চিমা মুভির সাথে সে আবার ফিরে আসে নতুন উদ্যমে, নতুন মোডকে। যে-জুতোটা তৈরি হয়েছিল ঘোড়সওয়ারি বা কসাইদের প্রয়োজনে, সেটাই এখন কালের সাথে পাল্টে গেল পুরো অন্য কিছুতে। অর্থাৎ, সময় বদলেছে, সেই সাথে হাই হিল জুতোর লিঙ্গপরিচয় বদলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ