অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা কতটা, অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে ব্যাংকের সুরক্ষা কতটা জরুরি, সেই আন্তঃসম্পর্কে আলো ফেলে নোবেল পুরস্কার পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন অর্থনীতিবিদ।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস সোমবার অর্থনীতিতে চলতি বছরের নোবেলজয়ী হিসেবে বেন এস বেরনানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড এবং ফিলিপ এইচ ডিবভিগের নাম ঘোষণা করে।
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার ভাগ করে নেবেন তারা।
তারা তাদের গবেষণা কাজের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন, আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণে এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ব্যাংক কতটা ব্যবহারিক গুরত্ব বহন করে।
সোমবার অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার সময় রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে বলা হয়, ‘‘অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা কী তা আমাদের আরো ভালোভাবে বোঝাতে বেন এস বেরনানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড এবং ফিলিপ এইচ ডিবভিগের কাজ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
‘‘তাদের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান হল কেন ব্যাংকের পতন এড়ানো জরুরি।”
একাডেমির পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, বেরনানকে পরিসংখ্যানগতভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকে যখন গ্রাহকরা দ্রুত তাদের আমানত তুলে নিতে শুরু করেন (ব্যাংক রান) তখন গ্রাহকদের এই আচরণই ব্যাংককে পতনের দিকে ধাবিত করে। কারণ, যত বেশি গ্রাহক তাদের আমানত তুলে নেবেন ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে।
এই প্রক্রিয়াতেই ১৯৩০’র দশকে একটি অপেক্ষাকৃত সাধারণ মন্দার আশঙ্কা তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় পরিণত হয়েছিল। যেটিকে এখনো বিশ্বের সবচেয়ে নাটকীয় এবং গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট বলে বিবেচনা করা হয়।
ব্যাংক রান’ বা ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা তাই সহজেই একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনায় পরিণত হয় উঠতে পারে এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে ধসিয়ে দিতে এবং পুরো আর্থিক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
কিভাবে এই ঝুঁকি এড়ানো যায় সেই পরামর্শ দিতে গিয়ে একাডেমি থেকে বলা হয়, ‘‘আমানত বীমা প্রদানের মাধ্যমে এবং ব্যাংকগুলিকে চরম বিপদের সময় ঋণদাতার ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে সরকার অর্থনীতির বিপজ্জনক ওই গতিশীলতা প্রতিরোধ করতে পারে।”
এই তিন অর্থনীতিবিদের নোবেল জয় অনেক তাৎপূর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দেশের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এ বিষয়ে তিনি তার ফেসবুকে নোবেল পুরস্কারের বিষয় ও বাংলাদেশের ব্যাংকিং পরিস্থিতির বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য লিখেছেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সেখানে বলেছেন, ‘এ বছর আর্থিক খাতের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য যে ৩ জন অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তারা সবাই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। ৩ জনের বয়সই সত্তুরের কাছাকাছি এবং এ বিষয়ে তাদের গবেষণার শুরু আশির দশকের প্রথম থেকে। শুধু উন্নত দেশের জন্যই নয়, স্বল্পোন্নত দেশের ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের গবেষণা থেকে দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে।’
ইতোমধ্যে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া থেকে উদ্ধার করার ঘটনা দেখা গেছে, অনেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতার ঘাটতি নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু অবস্থার খুব উন্নতি হচ্ছে বলা যাবে না।
‘এর আগেও আর্থিক খাতের বিশ্লেষণের জন্য ১৯৯৭ সনে দুজন এবং ২০১৩ সনে ৩ জন অর্থনীতিবিদকে যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের সবারই গবেষণা ছিল শেয়ার বাজারের গতি-প্রকৃতি ও উত্থান-পতন নিয়ে। ওই সব বিশ্লেষণ শেয়ার বাজারের বিপর্যয় ঠেকাতে বা এ নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিতে খুব কাজে দেয়নি বলে মনে করা হয়। কারণ শেয়ার বাজারের কেনা-বেচার ধরন শুধু অর্থনীতির যৌক্তিক আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, যে কারণে স্নায়ু-অর্থনীতি বা neuro-economics নামে নতুন ধারার অর্থনীতি নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে।’
‘কিন্তু এবারের নোবেল বিজয়ীদের কাজ আর্থিক খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে এবং তাদের বিশ্লেষণ অনেক বেশি বাস্তবমুখী, যা ব্যাংক ব্যবস্থার সম্ভাব্য ধস ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তারা যে বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তার মধ্যে আছে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আমানতকারীদের আস্থার সংকট, ঋণ মঞ্জুর করার ব্যাপারে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব, ব্যাংকের তারল্য ও মূলধন ঘাটতির বিষয়ে সতর্কতা, সংকটাপন্ন ব্যাংকে বাঁচিয়ে রাখতে আমানতের ওপর যথেষ্ট অংকের বিমার ব্যবস্থা এবং যথা সময়ে সতর্ক না হবার খেসারত হিসেবে পরবর্তীতে দেউলিয়া ব্যাংকে বাঁচাতে সরকারের বড় অংকের ব্যয়ের বোঝা বহন।’
‘উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের জন্য এই সবগুলো বিষয়েই সতর্কতা জরুরি। যতদূর মনে পড়ে আমাদের ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত আমানতপ্রতি মাত্র ১ লাখ টাকা বিমাকৃত। ইতোমধ্যে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া থেকে উদ্ধার করার ঘটনা দেখা গেছে, অনেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতার ঘাটতি নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু অবস্থার খুব উন্নতি হচ্ছে বলা যাবে না। ব্যাংকে টাকা আমানত রাখার তেমন কোনো বিকল্প নেই বলে ব্যাংকখাতের সমস্যা সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না; কিন্তু যখন কোনো বিপর্যয় ঘটে তখন তার জন্য পুরো অর্থনীতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়। এবারের নোবেল পুরষ্কার অনেক দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য হুঁশিয়ারি বার্তা বহন করে এনেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৬
আপনার মতামত জানানঃ