বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের রাজনীতি এমন এক চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে, যেখানে বিরোধিতার চূড়ান্ত রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ধ্বংস, হিংসা আর জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতা। বিশেষত গত বছরের আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় যেসব পরিকল্পিত হামলা ও নৈরাজ্য চালানো হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিশেষ করে চাঁদা আদায়ের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো।
এমন ঘটনাগুলোর পেছনে স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাধারণ মানুষ জানতে চায়, কারা এই হামলার পেছনে, কাদের ইশারায় এসব সংঘটিত হচ্ছে এবং সরকার কেন এসব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ প্রশ্নগুলো এখন আর কেবল রাজনৈতিক আলোচনা বা টকশোর বিষয় নয়—এগুলো সাধারণ মানুষের উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারণ, এসব সহিংসতার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর।
সরকারের দায়িত্ব এখানে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, বরং একটি সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রের মত চলমান সহিংসতা বন্ধ করে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সরকার শুধু ঘটনাগুলোর নিন্দা জানিয়েই দায় সারছে। কোনো ঘটনার পরপরই কিছু গ্রেফতার, কিছু বক্তব্য, কিছু বিচ্ছিন্ন তদন্ত—এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে পদক্ষেপ। অথচ হামলাকারীদের অনেকেই খোলা চোখে সনাক্তযোগ্য, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিভিশনের ফুটেজে তাদের মুখ দেখা যায়। তবুও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, বা হলেও তা এত ধীরগতিতে হয় যে তাতে জনগণের আস্থা আরও কমে যায়।
বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এসব সহিংসতার পেছনে শুধু রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধিতা নেই, রয়েছে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা কিছু গোষ্ঠী এলাকার ব্যবসায়ী, প্রবাসী বা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে। এই চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি অঘোষিত অর্থনৈতিক বলয়, যা মূলত ভয়ভীতির ভিত্তিতে টিকে আছে। হামলা, অগ্নিসংযোগ কিংবা বিক্ষোভের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এসব কার্যক্রম অনেক সময় রাজনীতির নামে হলেও বাস্তবে তা নির্ভেজাল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়া কিছু নয়।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে, সরকার কি আদৌ চায় এসব দমন করতে? নাকি কোনো গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে এসব সহিংসতা মেনে নিচ্ছে? সরকার কি কিছু গোষ্ঠীর প্রতি এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? কিংবা, রাজনৈতিক সুবিধার খাতিরে এসব গোষ্ঠীর সহিংসতা উপেক্ষা করা হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকার এখনো দেয়নি, কিংবা হয়তো দিতে পারবেও না। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের নিরাপত্তা, দেশের স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ।
অন্যদিকে, সাধারণ জনগণের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মানুষ মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও শাসানো হয়, হয়রানি করা হয়। এই ভয়ভীতির সংস্কৃতি আমাদের নাগরিক সমাজকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। অথচ গণতন্ত্রে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস। জনগণের সক্রিয়তা, সচেতনতা ও সংগঠিত প্রতিবাদ না থাকলে কোনো সরকারই দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয় না। তাই সহিংসতা বন্ধ করতে হলে, শুধু সরকারের নয়, জনগণের দিক থেকেও একটি সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মিডিয়ার ভূমিকা। গণমাধ্যমের অনেকাংশ এখন দলীয় অবস্থান থেকে সংবাদ পরিবেশন করে। সহিংসতাকে কে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে, সেটা নির্ভর করছে তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ওপর। এতে সত্য বিকৃত হয়, দোষীদের রক্ষা করা হয় এবং সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। মিডিয়ার উচিত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা, দোষীদের নাম প্রকাশ করা এবং জনগণকে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ দেওয়া। এতে একদিকে যেমন অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সহায়তা হবে, অন্যদিকে সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি হবে।
এসব আলোচনার আলোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বাংলাদেশে সহিংসতা একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। এর সমাধানও তেমন জটিল এবং বহুস্তরীয়। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, জনগণের সচেতনতা এবং মিডিয়ার নিরপেক্ষতা—সব মিলিয়েই তৈরি করতে হবে একটি সহিংসতা-বিরোধী কাঠামো। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, থাকবেই; কিন্তু মতবিরোধের মাধ্যম কখনোই অস্ত্র হতে পারে না। মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, তবে তা হতে হবে শান্তিপূর্ণ, যুক্তিবাদী ও গণতান্ত্রিক উপায়ে।
সবশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও চাঁদাবাজির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সহিংসতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ক্রমেই দুর্বল করে দিচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ চাইলে শুধু সরকার নয়, আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, প্রশ্ন তুলতে হবে, প্রতিবাদ জানাতে হবে—তবেই বদল সম্ভব। সহিংসতার এই অন্ধকার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন আলোকিত সচেতনতা, সত্যিকারের নেতৃত্ব এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃঢ় প্রত্যয়।
আপনার মতামত জানানঃ