ইতিহাসে প্রথম সফলভাবে আকাশে ডানা মেলেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন আব্বাস ইবনে ফিরনাস। তিনি ৯ম শতাব্দীতে উমাইয়া খিলাফতের সময় স্পেনের আন্দালুসিয়ার একজন পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তার উড্ডয়ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে. হিট্টি তার হিস্ট্রি অব আরব গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “ইবনে ফিরনাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশে ওড়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে।”
সর্বপ্রথম আকাশে কোনো বস্তু ওড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন দুই চীনা দার্শনিক মোজি ও লু বান। ঘুড়ি আবিষ্কারের নেপথ্যেও তারা দু’জন। পঞ্চম শতাব্দীতে এর মাধ্যমে তারা শত্রু রাষ্ট্রের ওপর নজরদারি করেছিলেন বলে জানা যায়। আর বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো যন্ত্র নিয়ে আকাশে ওড়া প্রথম মানুষ ইবনে ফিরনাস এবং মানুষের আকাশে ওড়ার পথপ্রদর্শকও এই মুসলিম দার্শনিক।
আব্বাস ইবনে ফিরনাসের পুরো নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি (জন্ম ৮১০, মৃত্যু ৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তার জন্মস্থান ছিল স্পেনের রোনদায়।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম যান্ত্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করলেও তারও অনেক আগে নবম শতাব্দীর বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস প্রথম মানুষ যিনি এক জোড়া পাখা নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন। তার পাখাগুলো তৈরি করা হয়েছিল রেশম, কাঠ ও পাখির পালক দিয়ে। ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র নকশাগুলো তৈরি করার ৬০০ বছর আগে এবং রাইট ব্রাদার্সের বিখ্যাত বিমান চালানোর ১০০০ বছরেরও আগে, ইবনে ফিরনাস কাজটি করেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে ফিরনাসের বয়স যখন ৬৫ থেকে ৭০ সে সময় তিনি ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস পর্বতের চূড়া থেকে উড়াল দেন। ১০ মিনিটের মতো তিনি আকাশে ভেসে ছিলেন। তবে সংক্ষিপ্ত ওই ফ্লাইটে তাকে আহত ও হতাশ দুটোই হতে হয়েছিলেন। কারণ ইবনে ফিরনাস ওড়ার কারিগরি বিষয়গুলো ঠিকভাবে সম্পাদন করলেও ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। যে কারণে ওড়ার সময় তিনি ভারসাম্য রাখতে পারেননি।
বৈপ্লবিক ওই উড্ডয়নের সমাপ্তি হয়েছিল ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে। ওই উড্ডয়নের পরও ১২ বছর বেঁচে ছিলেন ইবনে ফিরনাস। সে সময়টাতে তিনি এই বিষয়ে কাজ করেছেন। পাখির ওড়া ও অবতরণের ওপর বিস্তর গবেষণা করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিরাপদ ল্যান্ডিংয়ের জন্য দরকার পাখা ও লেজের সমন্বয়।
এরপর ইবনে ফিরনাস তার কয়েক দশকের গবেষণার উপসংহারে পৌঁছান। তার গবেষণাই পরবর্তী সময়ে অরনিথপটার বানানোর পথ দেখিয়েছে। অরনিথপটার হচ্ছে সেই আকাশ যান, যেটি পাখির মতো ডানা ঝাঁপটে আকাশে ভেসে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বিমানের ইঞ্জিন তৈরিতেও ইবনের ফিরনাসের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ইবনে ফিরনাস পাখি ও বিভিন্ন উড়ন্ত বস্তুর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর যন্ত্র তৈরি করে ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস থেকে আকাশে ওড়েন। এর কয়েক শতাব্দী পর ১৬৩০ সালে তুরস্কের বিজ্ঞানী আহমেদ সেলেবি আকাশে উড়ে ইস্তানবুলের বসফরাস প্রণালি পাড়ি দেন।
আকাশে ওড়া ছাড়াও ইবনে ফিরনাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা করতেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পানির শক্তিতে চলা ঘড়ি। বালি ও স্ফটিকের প্রকৃতি বিষয়েও ছিল তার গবেষণা। অনেক ইতিহাসবিদ স্বচ্ছ কাচ তৈরির কৃতিত্বও দেন তাকে। বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান কাচ তৈরির নেপথ্যেও ইবনে ফিরনাসের নাম বলেন অনেকে। যে কাচ এখনও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্ষীণদৃষ্টি শক্তির মানুষদের জন্য যে চশমা ব্যবহৃত হয় সেই কাচ আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে তার দীর্ঘ গবেষণা।
৮৮০ থেকে ৮৯০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আব্বাস ইবনে ফিরনাস ইন্তেকাল করেন। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের সেই আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ