চিকিৎসক সংকটে কারাগারে একের পর এক অসুস্থ কয়েদির মৃত্যু হচ্ছে, আত্মহত্যাও করছে। কিন্তু এসব ব্যাপারে যেন একেবারে নীরব প্রশাসন ও সরকার।
জানা গেছে, দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয়, ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারের জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৪১টি। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ১৩৭টি পদ খালি পড়ে আছে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের কারাগারগুলোতে প্রায় ৮৩ হাজার বন্দী রয়েছেন। কিন্তু তাদের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র চারজন। ভিআইপি বন্দীরা কারাগারের বাইরে কিছু হাসপাতালে সেবা নিতে পারলেও সাধারণ বন্দীদের বেশির ভাগের ভাগ্যে চিকিৎসা জোটে না। এভাবে আরেক ধরনের ‘নির্যাতন’ বা ‘শাস্তি’ ভোগ করতে হচ্ছে তাদের। এতে অনেক সময় কয়েদির মৃত্যু হচ্ছে। আবার আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
কারাগারের নিয়মানুযায়ী, প্রতিটি কারাগারে একজন মনোরোগ চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কোনো কারাগারে এই চিকিৎসক নেই। অথচ কারাবন্দী রোগীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং (পরামর্শ) ও বিশেষায়িত চিকিৎসা দরকার। নেই প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো চিকিৎসক। অন্যদিকে কারাগারের প্রায় তিন হাজার নারী বন্দী থাকলেও তাদের গাইনিসহ অন্যান্য রোগের কোনো চিকিৎসকই নেই। এ অবস্থায় অসুস্থ বন্দীদের স্থানীয় বা বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হচ্ছে। ফলে বন্দী নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
জানা যায়, সারা দেশের কারাগারগুলোতে মোট বন্দীর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। তবে এখন বন্দীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি, প্রায় ৮২ হাজার ৭৬৬ জন। কারাবন্দী রোগীদের প্রায় অর্ধেক যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। তাদের ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগে। এসব বন্দীর চিকিৎসায় অনুমোদিত চিকিৎসক আছেন মাত্র চারজন।
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসক-সংকটের কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুর্ধর্ষ আসামিদের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, এই কারাগারে প্রায় ১০ হাজার বন্দীর বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। সেখানেও চিকিৎসক আছেন একজন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশের বিভিন্ন কারাগারে কমপক্ষে ৪৩জন বন্দী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৪জন সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং বাকি ২৯জন বিচার বা তদন্ত মোকাবেলা করছিলেন।
সংস্থাটি বলছে, কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে এমন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮১। তার আগে ২০২০ সালে ৭৫ এবং ২০১৯ সালে ৫৮ জন বন্দীর মৃত্যু হয় বিভিন্ন কারাগারে।
কারাবন্দী রোগীদের প্রায় অর্ধেক যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। তাদের ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগে। এসব বন্দীর চিকিৎসায় অনুমোদিত চিকিৎসক আছেন মাত্র চারজন।
চলতি বছরের জুনে গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি গোলাম মোস্তফার মৃত্যু হয়। শৌচাগারের ভেতরে ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে পায়জামার ফিতা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে তদন্তে বলা হয়েছে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এ আফাজ উদ্দিন (২০) নামের এক হাজতির মৃত্যু হয়। তিনি আগের দিন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে কারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে না পেরে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ২০ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে গাজী সালাহউদ্দিন (৬০) নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। তিনি দি ফার্মাস ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রাক্তন ক্রেডিট বিভাগের প্রধান।
কারা কর্তৃপক্ষ এসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করছে। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, পরিবার এবং এমনকি সাধারণ মানুষ মনে করেন, চিকিৎসা না পেয়ে বা কারা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এসব বন্দী মারা গেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এটির উন্নতিতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে কারাগারে এর আগেও বন্দী মারা গিয়েছে।
তারা বলেন, ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্টের ১৩ ধারা মতে, একজন বন্দীর পূর্ণ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার প্রতি ২৪ ঘণ্টা অন্তর বন্দীদের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও তাদের নানা অসুস্থতা সম্পর্কে জানার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে মানা হয় না। এদিকে ১৮৬৪ সালের জেলকোড বন্দিদের চিকিত্সা পাওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ ব্যবস্থা রেখেছে।
এ বিধান অনুযায়ী, কোনো বন্দী অসুস্থ হলে প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে হেড ওয়াড্রেনকে জানানোর কথা রয়েছে। তিনি সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জনকে বন্দির অসুস্থতা সম্পর্কে জানাবেন। এরপর অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন সঙ্গে সঙ্গে বন্দীর ওয়ার্ড ভিজিট করবেন। বন্দীর অবস্থা বুঝে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে ১৮৬৪ সালের জেলকোডে। এ বিষয়ে তিনি জেলার এবং মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। বাংলাদেশের জেলখানায় এ নিয়মগুলো মানা হয় না বলে অনেকের অভিযোগ।
বর্তমান সরকারের আমলে কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশেষ করে বিরোধী বা ভিন্নমতের মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে। এর দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে। তারা বলেন, কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৬
আপনার মতামত জানানঃ