ভারতে মুসলিমদের ওপর ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে বিভিন্ন সচেতনত মহল। গণমাধ্যমেও উঠে আসছে এই ভয়াবহতা। তবে এ সব সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতে মুসলিমদের ওপর চলমান বিদ্বেষ ও সহিংস আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। নির্যাতন-নিপীড়নে সেখানে প্রচণ্ড উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ড, হামলা-আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বৈষম্য-অসম, ঘরবাড়ি ভাংচুর, ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস ও প্রার্থনায় বাধা প্রদান প্রভৃতি ঘটনার সুস্পষ্ট রিপোর্ট রয়েছে। পাশাপাশি মসজিদে পুজো করার মতো নিন্দনীয় ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি দেশটির শতাব্দী প্রাচীন মসজিদে পুজোর জন্য আবেদন গ্রহণ করে জ্ঞানবাপী মসজিদের তরফে করা আবেদন খারিজ করেছে বারাণসীর আদালত। পাশাপাশি আরও অনেক মসজিদেই পুজো করার দাবি তুলছে দেশটির উগ্র হিন্দুধর্মাবলম্বীরা।
এরই মধ্যে এবার ভারতে একটি ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে পুজো করেছে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দশেরার মিছিলের অংশ ছিল এমন একটি জনতা গত বুধবার (৫ অক্টোবর) রাতে কর্ণাটকের বিদারে কয়েকশত বছরের পুরোনো ওই মাদ্রাসায় প্রবেশ করে, স্লোগান দেয় এবং ভবনের এক কোণে পুজো করে।
এ ঘটনায় নয়জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে এবং চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবশ্য শুক্রবারের (৭ অক্টোবর) মধ্যে কাউকে গ্রেপ্তার না করা হলে বিক্ষোভের হুমকি দিয়েছিল মুসলিম সংগঠনগুলো।
শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের বিদারে অবস্থিত মাহমুদ গাওয়ান মাদ্রাসায় গত বুধবার রাতে এই ঘটনা ঘটে।
১৪৬০-এর দশকে নির্মিত এই মাদ্রাসাটি ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের মনোনীত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। অর্থাৎ এটি ৫৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো মাদ্রাসা। এছাড়া এই মাদ্রাসাটি ভারতের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসৌধের তালিকায়ও রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ‘জয় শ্রী রাম’ এবং ‘হিন্দু ধর্ম জয়’ স্লোগান দিতে দিতে ওই মাদ্রাসার সামনে হাজির হয় ভিড়। তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে মাদ্রাসার সিঁড়িতে দাঁড়িয়েও ওই স্লোগান দিতে থাকেন ভিড়ে শামিল হয় মানুষজন। এর পর মাদ্রাসার এক কোণে পুজো সারেন তারা। অশান্তি চলাকালীন মোবাইল ফোনে কিছু মানুষ গোটা ঘটনা ক্যামেরাবন্দি করেন। সেই ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
পুলিশ জানায়, উত্তেজিত জনতা মাদ্রাসার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে প্রবেশের পর তারা মাদ্রাসার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ‘জয় শ্রী রাম’ এবং ‘হিন্দু ধর্মের জয়’ স্লোগান দেয়। এরপর তারা পুজো করার জন্য সেখানকার একটি ভবনের কোণায় যায়।
অনলাইনে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মাদ্রাসার ভেতরে সিঁড়িতে বিশাল ভিড়, তারা সেখানে ভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।
Visuals from historic Mahmud Gawan masjid & madrasa, Bidar, #Karnataka (5th October). Extremists broke the gate lock & attempted to desecrate. @bidar_police @BSBommai how can you allow this to happen? BJP is promoting such activity only to demean Muslims pic.twitter.com/WDw1Gd1b93
— Asaduddin Owaisi (@asadowaisi) October 6, 2022
এর আগে স্থানীয় পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, এই ঘটনায় নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এখনও (তখন পর্যন্ত) কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অবশ্য পরে চারজনকে আটকের কথা জানায় পুলিশ।
এদিকে বিদারের বেশ কয়েকটি মুসলিম সংগঠন এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার না করা হলে শুত্রবার জুমার নামাজের পর ব্যাপক আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তারা।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই ঘটনার জন্য রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপিকে অভিযুক্ত করেছেন এবং এই ধরনের ঘটনাকে ‘মুসলিমদের হেয় করার’ জন্য প্রচার করার অভিযোগ তুলেছেন।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি বলেন, মুসলিমদের ছোট করে দেখানোর কারণেই এই ধরনের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। ট্যুইটারে আসাদউদ্দিন লেখেন, ‘কর্নাটকের বিদারের ঐতিহাসিক মাহমুদ গাওয়ান মসজিদ এবং মাদ্রাসার ভিডিও প্রকাশ্যে। উগ্রপন্থীরা তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং ওই স্থানটিতে অপবিত্র করে তোলে। বিদার পুলিশ এবং মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বম্মাইকে বলব, কী করে এমন ঘটতে দিতে পারেন আপনারা? মুসলিমদের ছোট করে দেখিয়ে বিজেপি-ই এই ধরনের ঘটনায় উস্কানি জোগাচ্ছে’।
এনডিটিভি বলছে, সমালোচকরা বিজেপির বিরুদ্ধে রাজ্যের কিছু অংশকে সাম্প্রদায়িক পরীক্ষার জন্য রণক্ষেত্রে পরিণত করার অভিযোগ করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের পর এই অভিযোগগুলো উঠতে শুরু করে এবং হিন্দু গোষ্ঠীগুলো মন্দিরের মেলা থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ করার পর এই অভিযোগ আরও জোরদার হয়।
এর আগে গত আগস্টে কর্ণাটকের হুবলি শহরের একটি ঈদগাহ মাঠে গণেশ চতুর্থী পালন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।
এই প্রসঙ্গে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-কে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটি হলো ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর প্যারেন্ট সংগঠন। এর শাখা প্রশাখা হলো বিজেপি, বজরং দল, কর সেবক, যুব বাহিনী ইত্যাদি।
উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হলেন আরএসএসের একজন ক্যাডার। এই নেতা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই একের পর এক মুসলিম বিরোধী তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছেন। গোমাংস ভক্ষণ এবং ঘরে গোমাংস রাখার তথাকথিত অপরাধের কারণে একাধিক মুসলমানকে নির্যাতন, প্রহার এবং হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।
তারা গরুকে গো মাতা বলে মনে করে। এটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের এই বিশ্বাসের ব্যাপারে মুসলমানদের কোনো কিছু বলার নাই এবং বলেও না। কিন্তু এই ভারত যখন গোমাংস রপ্তানী করে লক্ষ কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা আয় করে তখন এই গোনিধন কোথায় যায়, তার কোনো জবাব তারা দিতে পারে না।
বর্তমানে মুসলিম স্থাপত্য ও সভ্যতার নাম নিশানাকে মুছে ফেলে দেওয়ার ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের বিজেপি সরকার। দেশটিতে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কুতুব মিনারকে বিষ্ণু স্তম্ভ করার অপচেষ্টা হচ্ছে। কীভাবে মথুরার শাহী ঈদগাহ্ মসজিদের ১৩ একর জমি গ্রাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য তাজমহলকে তেজ মহালয় বানানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। জ্ঞানবাপী মসজিদে শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে, এই জিগির তুলে বাবরি মসজিদের মত জ্ঞানবাপী মসজিদকেও মন্দিরে রূপান্তরের চক্রান্ত করা হচ্ছে।
এলাহাবাদ, ফয়েজাবাদ, মুজাফফর নগর, আহমেদাবাদ, আগ্রা প্রভৃতি জগৎ বিখ্যাত শহরের মুসলিম নামকে হিন্দু নামে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ৪৪টি রাস্তার নাম বদলে হিন্দু ব্যক্তিদের নামে করার ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ