সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে। কেউবা দখলে নেমেছে প্রকাশ্যে!
দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সীতাকুণ্ড রিজার্ভ ফরেস্ট সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা জঙ্গল সলিমপুর। প্রায় ৩১০০ একর জায়গা জুড়ে এটি বর্তমানে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বস্তি; ধারণা অনুযায়ী এ স্থানে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। এ এলাকার ৪৫টি পাহাড়ে প্রায় ২০০ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি চেয়ে আবেদন করেছে জেলা প্রশাসকের কাছে।
এর মধ্যে রয়েছে বিজিএমইএ, চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, র্যাব, পুলিশ ও আনসার।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাহাড় রক্ষা ও সরকারি জমি উদ্ধারের জন্য উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০০ একর জমি উদ্ধার করেছে। বাকি জায়গাটি উদ্ধারের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ বিষয়টিই নজর পড়ে সকলের। এছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নিজেও এই খাস জমিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, নভোথিয়েটার, স্পোর্টস ভিলেজ, হাসপাতাল, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র, নাইট সাফারি পার্কসহ একাধিক সরকারি স্থাপনা তৈরি করতে চায়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বায়েজিদ এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দুরত্বের এই এলাকাটি একসময় ছিলো পাহাড়ি জঙ্গল। নগরীতে বিভিন্ন সময়ে বস্তি উচ্ছেদের পর ভূমিহীন মানুষেরা এই জঙ্গলে গিয়ে বসতি শুরু করে। নব্বই দশক থেকেই সেই পাহাড়ে বসতি শুরু হয়। ভূমিহীন মানুষের এই অবহেলিত জঙ্গলসলিমপুরের নাম হয় ছিন্নমূল।
গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে ছিন্নমূল নিয়ে বৈধকে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে টাস্কফোর্স কমিটি গঠিত হয়। এরপর থেকে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শুরু করে সিডিএ।
এদিকে পাহাড়ে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে পাহাড়ের খাস জমি বরাদ্দ পেতে প্রভাবশালীরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১২৩ একর ভূমি চাওয়া হয়েছে। সেখানে এন্টারটেইনমেন্ট জোন, মাল্টিপারপাস কনভেনশন সেন্টার, কিচেন মার্কেট, হলিডে মার্কেট, আবাসিক এলাকা, শপিং কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে চায় সংস্থাটি।
এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ একর এবং স্বতস্ত্র গার্মেন্টস জোন স্থাপনের সরকারের কাছে ২০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছে।
জঙ্গল সলিমপুরে এই বসতি নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ এর অধীনে, তাদের তথ্যমতে এখানে বর্তমানে প্রায় ২৪ হাজার পরিবারের বসবাস।
তবে সীতাকুণ্ড উপজেলার ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জঙ্গল সলিমপুর ১৬ হাজার ৪০০টি প্লটে, ১০ হাজার ৯৫০টি পরিবারের বসবাস।
২০০৪ সালে গঠিত হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ।
সরকারি সুযোগ সুবিধা না পেয়ে তারা এই ১৮ বছরে নিজেদের মত করে সেখানে রাস্তা-ঘাট, স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলে।
প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ প্রধান সড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করেছেন বস্তিবাসিরা। বৈধভাবে আবাসিক সংযোগ না পেলেও বিদ্যুৎ বিভাগকে ম্যানেজ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদ্যুতের বানিজ্যিক সঞ্চালন লাইন। স্থানীয় সাংসদ ও কিছু দাতব্য সংস্থা সেখানে বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে দিয়েছেন।
জঙ্গল হওয়ায় আইনশৃংখলা বাহিনীর বেগ পেতে হতো এই বস্তি তদারকিতে। ছিন্নমূলের ৮৫০ একর এলাকার বাইরে প্রায় ২,২৫০ একর এলাকায় ভূমিদস্যুরা বিভিন্নভাবে দরিদ্র মানুষের কাছে বাড়ি বিক্রি ও ভাড়া দিচ্ছে।
বসতি শুরু হলে সরকারি অফিসার, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিকসহ অনেকেই সেখানে প্লট নিয়ে এই শহরমুখী গরীদের মাঝে ভাড়া দেন। সেখানে ঘটতো অপরাধ কর্মকাণ্ডও।
এদিকে সম্প্রতি রাজধানীতে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদ। তারা বলছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গল সলিমপুরে প্রায় ২৪ হাজার ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে সাফারি পার্ক নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরিষদ ওই সংবাদ সম্মেলন করেছে।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। সেখানে এতগুলো পরিবারকে তাদের দীর্ঘদিনের আবাস থেকে উচ্ছেদ মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে এ অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে।
জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ভূমিহীন কল্যাণ পরিষদ বলছে, হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ২৪ হাজার ভূমিহীন পরিবার উচ্ছেদ করে নাইট সাফারি পার্ক নির্মাণ করার চেষ্টা করছে একটি মহল। এ কাজে তাদের সহায়তা করছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। ৮ সেপ্টেম্বর সেখানে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এতে আহত হয়েছেন সেখানকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা।
ওই পরিষদ আরও বলছে, বছরের পর বছর পাহাড় কেটে জায়গাটিকে বসবাসের উপযোগী করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ২০১০ সাল থেকে সেখানে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রায় ১২ হাজার ভোটার বাস করছেন সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্তানেরা স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। ১৫ সেপ্টেম্বর ৩৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবে। এলাকায় ১০টি কিন্ডারগার্টেন, ১৫টি মাদ্রাসা, ১৮টি মসজিদসহ রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, বাজার, মাজার, গোরস্তান, শ্মশান। এ রকম একটি জায়গার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে নাইট সাফারি পার্ক নির্মাণ করা অন্যায়।
পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ ভালো সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে সরকারি অবকাঠমো গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা, সেটি আরো ভয়ংকর।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ বলেছে, গত বছরের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন যে জঙ্গল সলিমপুরের ২৪ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ২২ দিন এলাকাটি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। ওই এলাকায় পুলিশ, র্যাব, ম্যাজিস্ট্রেট তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে প্রায় তিন হাজার মানুষ চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলে সীতাকুণ্ডের উপেজলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে বিদ্যুৎ–সংযোগ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু পরে একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনায় ৪৫ জনকে এজাহারভুক্ত করে ৮৮৫ জনকে আসামি করে ৭টি মামলা করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত দুই দশকে জঙ্গল সলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকার এই পাহাড়ধসে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষসহ অন্তত ২২ জন। সর্বশেষ গত এক যুগ আগে ছিন্নমূল এলাকায় পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনার পর সলিমপুর এলাকায় পাহাড় দখল ও পাহাড় কাটা বন্ধে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আল মামুনকে প্রধান করে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। প্রস্তাবিত কমিটি তিন দফা বৈঠকের পর ছয়টি সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং চারটি সুপারিশনামা দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু প্রতিবেদন দাখিলের পর তা আজও বাস্তবায়িত না হয়ে পড়ে রয়েছে ফাইলবন্দী অবস্থায়।
এলাকাবাসী জানায়, জঙ্গল সলিমপুরের ছিন্নমূল সমবায় সমিতিতে সাড়ে ১৫ হাজার পরিবার এবং অলিনগর সমবায় সমিতিতে প্রায় ছয় হাজার পরিবার রয়েছে। প্রত্যেক পরিবারে সদস্য গড়ে পাঁচজন হলে জনসংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ১০ হাজারের মতো। অবৈধ বসবাসকে বৈধ করতে সমিতির নেতারা বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদ ও মন্দির স্থাপন করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পন্থায় এখানে আনা হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির লাইনসহ নানা সুবিধা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ ভালো সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে সরকারি অবকাঠমো গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা, সেটি আরো ভয়ংকর। এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের লালদিয়ার চর থেকে ১৪ হাজার মানুষকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তাদের এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি। একইভাবে ২০১৩ সালে বস্তিবাসীদের আবাসনের জন্য চসিকের বানানো ভবনটি নিজেরাই দখলে নিয়ে নগর ভবন বানিয়েছে। জঙ্গল সলিমপুরেও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না করেই উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে। এমনকি প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা, চলাচলের রাস্তা বন্ধ, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের আবার উদ্বাস্তু বানানো কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তারা বলেন, জঙ্গল সলিমপুর ও আলী নগরে যেসব ছিন্নমূল লোকজন বসবাস করছে তারা একদিনে সেখানে থিতু হয়নি। তাদের প্রলোভন দেখিয়ে সরকারি জমি কেনাবেচা ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছে কিছু প্রভাবশালী। প্রশাসন এসব বিষয় জানলেও এতদিন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর নির্লিপ্ততায় এসব সাধারণ মানুষ পদে পদে ঠকেছে। জাল দলিলের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে প্রতারণ করা হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই তারা সেখানে দখলদারিত্বের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারত না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৪
আপনার মতামত জানানঃ