বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যত অভিযোগ তা ১৬ বছর আগের। অর্থাৎ যখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। এরপর দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ চালিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগই এখন একটানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায়। আর এখন বিএনপির বিরুদ্ধে জানানো ওই সব অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও। যদিও আওয়ামী লীগ শুধু বিএনপির দিকেই আঙুল তুলছে। আয়নাতে নিজের মুখটা দেখছে না।
বিএনপির আমলে আইনের শাসনের ঘাটতি ছিল। এখনো আছে। বিএনপির আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন চালাত। এখনো বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন চলছে। কুশীলব ও লক্ষ্যবস্তু বদলে গেছে মাত্র।
বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মার খেতেন। এখন ঘটছে উল্টোটি। বিএনপির আমলে বিদেশে অর্থ পাচার হতো। সেই পাচারকৃত অর্থের সামান্য অংশ ফেরত এনে আওয়ামী লীগ সরকার বাহবা নিয়েছে, এখন তার চেয়ে কয়েকশ’ গুণ অর্থ পাচার হচ্ছে। একটি পয়সাও ফেরত আনতে পারেনি।
জিএফআইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪২৬ কোটি মার্কিন ডলার। একই ধারায় ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি টাকা পাচার হয়। ২০১৫ সালে এক হাজার ১০১ কোটি ডলার পাচার হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে পাচার হয়েছে চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
বিএনপির আমলে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে ‘হাওয়া ভবন’ ছিল। এখন অনেক ভবনের নাম শোনা যাচ্ছে। পি কে হালদার নামের এক ব্যবসায়ী সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করে এখন ভারতের জেলে আটক। পুলিশের এক থানা পর্যায়ের কর্মকর্তাও কয়েক শ কোটি টাকা পাচার করেছেন।
বিএনপির আমলে সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি হতো। এখনো দুর্নীতি হচ্ছে। মাত্রা আরও বেড়েছে। বিএনপির আমলে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণে আইসিটি আইন হয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে তার উন্নত সংস্করণ দেখছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
এই সময়ে দুর্নীতি বাংলাদেশে জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা পাঁচ বছরে, সেই প্রকল্প ১১ বছরেও শেষ হচ্ছে না। বছরের পর বছর প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ঋণের বোঝা চাপানো হচ্ছে জনগণের মাথার ওপর। সীমিত আয়ের মানুষ যারা, আজ তারা প্রত্যেকেই দিশেহারা। প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ যত বাড়বে, সরকারের জন্য তা ততই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। কিছু মানুষের পেট ভরাতে গিয়ে পুরো দেশই এখন প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠছে।
বিএনপির আমলে সংখ্যালঘুরা উৎপীড়িত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের আমলেও এই উৎপীড়ন বন্ধ হয়নি। চলতি বছরের ৯ মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ৩০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর দুর্গোৎসবের সময় পরিকল্পিতভাবে বহু মন্দিরে-বাড়িতে হামলা হয়েছে।
বিএনপির আমলে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এখন ছাত্রলীগের আধিপত্য চলছে। তবে বিএনপির আমলে ছাত্রলীগ মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে যেতে পারত, ছাত্রদল এখন সেটাও পারে না। এখন শিক্ষাঙ্গনে মারামারি হয় ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের। এর সর্বশেষ উদাহরণ ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজ। সেখানে ছাত্রলীগের নেত্রীরা সিট–বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। সেখানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ আমরা দেখলাম।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তাতে দেশবাসী হতবাক। সেখানে ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলেন এবং তিনি অনুমতিও দিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই তাদের বেধড়ক পেটান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
কর্মসূচি নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে অনেক সময় পাল্টাপাল্টি বাধা–প্রতিপত্তি হয়ে থাকে। কিন্তু সেদিন ছাত্রদলের কোনো কর্মসূচি ছিল না উপাচার্যের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা ছাড়া। ভাবতেও অবাক লাগে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল শিক্ষার্থী আরেক দলের ওপর এভাবে হামলে পড়তে পারে? আওয়ামী লীগের নেতারা বলবেন, বিএনপির আমলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও এভাবে মার খেয়েছেন। জখম হয়েছেন। অর্থাৎ কুশীলব বদলায়, তাদের চরিত্র বদলায় না। আর তাই হয়তো হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ ও নির্যাতনের অনেক অভিযোগ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷
তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আমলের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। বিএনপির আমলে বিরোধী দল আন্দোলন করে সরকারকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্যও করতে পারত। এখন সে রকম বিরোধী দল নেই। নাগরিক সমাজ ম্রিয়মাণ। গণমাধ্যম সদা ভয়ে থাকে।
এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনেরা কাউকে পরোয়া করে না। বিএনপির আমলে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ছিল। এখন সবল হয়েছে এ কথা নিশ্চয়ই কেউ বলবে না। তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ফারাক কি কেবল স্লোগান আর পোশাকে?
আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিজের সংগঠনের দিকে একবার নজর দিলে বুঝতে পারতেন, বাইরে যতই তারা ক্ষমতার দাপট দেখান না কেন, ভেতরে-ভেতরে ঘুণ ধরেছে।
২০০৯ আর ২০২২ সালের আওয়ামী লীগ এক নয়। আওয়ামী লীগের ঘুণ সারানোর ওষুধ নিশ্চয়ই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। ওষুধ হলো নিজের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ