সরকার সমালোচক সাংবাদিকদের পরিবারে আটক-হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। গত মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ দাবি করেন।
সিপিজে জানায়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘সুরমা’ পত্রিকার সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের বড় ভাই নূর আলম চৌধুরী পারভেজকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই নোয়াখালী জেলা সদরের নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। অভিযোগপত্রে পুলিশ তার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সরকার বিরোধী প্রচারণার অভিযোগ এনেছে এবং অভিযোগ করেছে যে পারভেজ জনসাধারণের মধ্যে “বিভ্রান্তি ও আন্দোলন” তৈরি করতে লিটনের সাথে ষড়যন্ত্র করছে।
এদিকে শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর)মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বাসিন্দা ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুর রব ভুট্টোর ছোট ভাই আব্দুল মুক্তাদির মনুকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আব্দুর রব ভুট্টো যুক্তরাজ্যে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কটূক্তিমূলক স্ট্যাটাস দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে। এমন অপরাধে দেশে থাকা ওই প্রবাসীর ছোট ভাই ইউপি সদস্য ও বিএনপি নেতা মনুকে গ্রেপ্তারর করা হয়।
জানা গেছে, দেশে থাকাকালীন সময়ে আব্দুর রব ভুট্টো কুলাউড়া থেকে প্রকাশিত স্থানীয় সাপ্তাহিক হাকালুকি ও বেনী আসহকলা পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন। এছাড়া শীর্ষ নিউজের কুলাউড়া প্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানে লন্ডন বাংলা চ্যানেল নামে একটি ফেসবুক পেইজের সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
আব্দুল মুক্তাদির মনু রাউৎগাঁও ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ৫ বারের নির্বাচিত বর্তমান ইউপি সদস্য। তিনি বর্তমানে উপজেলা বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
পারভেজের মামলার সাথে পরিচিত এক ব্যক্তি সিপিজেকে বলেছেন, তিনি হাসিনা আক্তারের ভাই, যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিষয়ক টক শো টেবিল টক উইথ হাসিনা আক্তারের হোস্ট এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ডিজিটালের সম্পাদক শাহ আলম ফারুক। সংবাদ প্ল্যাটফর্মে গত ১৪ আগস্ট, লিটন সাপ্তাহিক সুরমার জন্য একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে যেখানে অর্থ পাচারের জন্য সরকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য হাসিনাকে আহ্বান জানানো হয়।
সিপিজে-এর সূত্র জানায়, তারা বিশ্বাস করে পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয় তার ভাইয়ের সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অথবা ৩০ আগস্ট জোরপূর্বক গুমের শিকার বাংলাদেশিদের সমর্থনে লিটনের একটি বিক্ষোভের আয়োজনের কারণে। পারভেজ আওয়ামী লীগের জোট দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের(ইনু) নোয়াখালী জেলা সভাপতি।
এদিকে, মনুর মামলার সাথে পরিচিত ব্যক্তি সিপিজেকে বলেছিলেন যে, তারা বিশ্বাস করে তার গ্রেপ্তার তার বড় ভাই ভুট্টোর সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার কাজের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে তিনি লন্ডন বাংলা চ্যানেলে চলতি বছরের আগস্ট মাসে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমানের সাথে দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। তার অভিযোগ, বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দারা তাকে ২০১১ এবং ২০১৮ সালে দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে গোপনে আটক করেছিল।
সেই ব্যক্তি সিপিজেকে বলেছিলেন যে ভুট্টো এই সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি বেনামী হুমকিমূলক কল এবং বার্তা পেয়েছিলেন। তাকে তার সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা বন্ধ করার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনামূলক সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে প্রতিশোধের একটি ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যাচ্ছে। যা কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অলক্ষ্যে যাওয়া উচিত নয়।’
সিপিজে জানিয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ, আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সিপিজে-এর পাঠানো ইমেলের কোনো জবাব দেয়নি।
এর আগে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বাংলাদেশি সাংবাদিক কনক সারওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে অক্টোবর ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত আটকে রেখেছিল এবং সুইডেন প্রবাসী নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিলের মাকে বারবার হয়রানি করেছে।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে সিপিজে-এর এশিয়া প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী বেহ লিহ ই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনামূলক সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে প্রতিশোধের একটি ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যাচ্ছে। যা কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অলক্ষ্যে যাওয়া উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এবং নিঃশর্তভাবে নূর আলম চৌধুরী পারভেজ এবং আব্দুল মুক্তাদির মনুকে মুক্তি দিতে হবে এবং বিদেশী-ভিত্তিক সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের আটক, হয়রানি এবং অন্যান্য ধরণের প্রতিশোধের শিকার হওয়া বন্ধ করতে হবে।’
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব অভিযোগ সরকার প্রত্যাখ্যান করলেও এভাবে নির্যাতন ও হয়রানি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, অনেক ক্ষেত্রেই যিনিই সরকার বা ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তির যৌক্তিক সমালোচনাও করেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে যদি তিনি নাগালের বাইরে থাকেন অর্থাৎ বিদেশে যদি অবস্থান করেন, তাহলে তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের ওপর খড়গহস্ত নেমে আসে এবং নানা ভাবে তাদের হয়রানি করেই ক্ষান্ত হয় না, নির্যাতন নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় ভয়ের পরিস্থিতি তৈরির জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় বা মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে দেয়া হয়।যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে গত কয়েক বছর।
তারা বলেন, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা— এটা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যে অধিকার আইন করেও খর্ব করা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত আজকে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন করার পরও আমরা এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৪
আপনার মতামত জানানঃ