অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেশটির সবচেয়ে বড় রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটন ধ্বসে পড়ার কারণে শ্রীলঙ্কাকে এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
এ কারণে কয়েক মাস ধরে সোয়া দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটিকে তুমুল লোডশেডিং, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, রুপির (শ্রীলঙ্কার মুদ্রা) ভয়াবহ অধোগতি এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানির বিল মেটাতে না পেরে ব্যাপকভাবে ভুগতে হচ্ছে। আর এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে তামিলরা।
শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত জেলা- মুল্লাইটিভু। মাথার ওপর দাউদাউ করছে মধ্যদুপুরের সূর্য। ৪৪ বছরের সিংগারাম সোসাইয়ামুত্তু তার বর্গা নেয়া চিনাবাদাম ক্ষেতে কোদাল চালাচ্ছেন। এই বাদাম বিক্রির টাকায় সংসার চলে সোসাইয়ামুত্তুর।
শ্রীলঙ্কা সরকার এবং লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম (এলটিটিই)-এর মধ্যে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের শেষদিকের কথা। ২০০৯ সালে একটি বিমান হামলায় দুটি পা হারান সোসাইয়ামুত্তু, একটি হাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভীষণভাবে। হাতের তালুতে ভর করে চলাফেরা করেন তিনি।
সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘একজন দৈনিক মজুরের চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয় আমার।’
৪৪ বছরের সিংগারাম সোসাইয়ামুত্তু তার বর্গা নেয়া চিনাবাদাম ক্ষেতে কোদাল চালাচ্ছেন।
গৃহযুদ্ধের পর বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট সোসাইয়ামুত্তুর জীবনে দ্বিতীয় বড় আঘাত। সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘এখানকার অনেক বাসিন্দা ভাড়ায় অন্যের জমিতে কাজ করেন। পা না থাকায় আমি পারি না।
‘কাজ করতে চাইলেও, কেউ আমাকে নেবে না। আমার পক্ষে অন্য দিনমজুরের মতো কাজ করাও সম্ভব না। এটাই বাস্তবতা। ’
অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন সোসাইয়ামুত্তু। তখন সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। বিপত্তি বাঁধে গত বছরের শেষ দিকে। সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক মন্দায় পরে শ্রীলঙ্কা। মুদ্রাস্ফীতি আর নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দাম… তাকে চিনাবাদাম চাষে যেতে বাধ্য করেছে।
সোসাইয়ামুত্তু বলেন, ‘আমরা না হয় কম খেয়ে কিংবা না খেয়েই দিন কাটাতে পারি। কিন্তু বাচ্চারা! ওদের কীভাবে বোঝাব?’
মিত্র দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ধার নিয়ে ভালোই চলছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। করোনা মহামারি এসে পাল্টে দেয় পরিস্থিতি। ধস নামে জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা পর্যটন শিল্পে। এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চরমে পৌঁছায় অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। উত্তরণের উপায় না পেয়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা সরকার।
সোসাইয়ামুত্তুর পরিবার শ্রীলঙ্কার সেই ৬২ লাখ মানুষের মধ্যে আছে, যাদের জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন-(এফএও) ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীন’ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরীয় দেশটিতে গত মাসে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৯৩.৭ শতাংশ রেকর্ড হয়।
গত কয়েক মাস ধরে বিদ্যুত বিভ্রাট, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, রুপি মান কমতে থাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করেছে শ্রীলঙ্কা। ২ কোটি ২০ লাখ জনংখ্যার দ্বীপটিতে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের সঙ্কট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় দরিদ্র জেলা এই মুল্লাইটিভু। এখানের ৫৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। সেভ দ্য চিলড্রেনের জুনের এক জরিপে দেখা গেছে, এ জেলার প্রায় এক চতুর্থাংশ বাসিন্দা সঙ্কটের কারণে বেকার হয়েছেন।
মুল্লাইটিভুর ৫৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। দেশজুড়ে চালানো জরিপে ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরদাতা জানিয়েছেন, সুসাইয়ামুত্তুর মতো তারাও সন্তানদের খাবার নিশ্চিত করার জন্য নিজেদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন।
অর্থনৈতিক এই সঙ্কট তাদের (মুল্লাইটিভু জেলার বাসিন্দাদের) খারাপ থেকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের আসলে সেই মঞ্চে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যেখানে তারা গৃহযুদ্ধের পরপর ছিল।’
দাতব্য সংস্থা টিয়ার্স অফ ভ্যান্নির প্রতিষ্ঠাতা সোমা সোমানাথন বলেন, ‘অর্থনৈতিক এই সঙ্কট তাদের (মুল্লাইটিভু জেলার বাসিন্দাদের) খারাপ থেকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাদের আসলে সেই মঞ্চে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যেখানে তারা গৃহযুদ্ধের পরপর ছিল।’
শ্রীলঙ্কার সামাজিক ক্ষমতায়ন মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি নীল হাপুহিনে বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ৬ লাখ মানুষকে প্রতি মাসে নগদ অর্থ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। চলতি বছর ৩২ লাখ পরিবারে ১৪৬ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হবে।
খাদ্য সঙ্কট দূর করতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে খাবারের সঙ্কট আপাতত মেটানো যাবে বলে মনে করছে দেশটির সরকার। অন্যান্য সঙ্কট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছে হাত পাতেছে শ্রীলঙ্কা সরকার।
স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা। ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্য আমদানিও। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তীব্র জ্বালানি সংকটে গণপরিবহন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারি, জাতীয় অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের অদক্ষতা, বিশ্বজুড়ে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জ্বালানি, খাবার এবং ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা। ডিজেলের সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারছে না শ্রীলঙ্কার বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রগুলো। ফলে গত কয়েক মাস ধরে সেখানে দিনের বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুত্ থাকছে না।
ফলে নজিরবিহীন এই সংকটের জন্য রাজাপাকসে পরিবারসহ দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারকে দায়ী করে শ্রীলঙ্কায় গণআন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করেছে। আন্দোলনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এমনকি রাজাপাকসে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সরকার থেকে সরে এসেছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৫
আপনার মতামত জানানঃ