ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের কেরালা অঞ্চলের রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর। ওই রাজার শাসনামলে কর আদায়ের এতো এতো খাত ছিল যে, রাজ্যের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তার উপর। বলা হয়ে থাকে, পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলেও কর দিতে হতো সেখানে।
তবে অত্যাচারী রাজার পদক্ষেপ এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নারীদের স্তন অনাবৃত রাখতে জোরাজুরি করেন তিনি। রাজা ত্রিভাঙ্কুর এমন একটি আইন করেন যাতে বলা হয় রাজ্যের নারীরা স্তন ঢেকে রাখতে হলে কোষাগারে কর দিতে হবে। আবার যার স্তন যতো বড় তার কর ততো বেশি ধার্য করা হয়।
যদিও ওই করের টাকা জনমানুষের জন্য মোটেও ব্যয় করা হতো না। নিয়ে যাওয়া হতো রাজধানীতে, ব্যয় করা হতো মন্দিরের কাজে। গিনেস বুকের রেকর্ড অনুযায়ী থিরু অনন্তপুরম শহরে অবস্থিত পদ্মনাভ মন্দিরটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির।
কেরালায় যখন চলছিল এমন অমানবিক অপরাধ তখনই ৩৫ বছর বয়সী নারী নাঙেলি এর প্রতিবাদ করেন। রাজার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজের স্তন কেটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২০০ বছরের বেশি সময় আগে এই ঘটনা ঘটেছিল মুলাছিপুরম এলাকায়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বৈষম্যমূলক স্তন করের বিরুদ্ধে তার আত্মত্যাগের বিষয়টি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
সম্প্রতি বিবিসি এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতের ওই রাজ্য থেকে নাঙেলিকে নিয়ে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরেন। আজ আমরা ওই নারী সম্পর্কে জানব।
ব্রিটিশ ভারতে ৫৫০টি রাজ্যের মধ্যে ত্রিভাঙ্কুর অন্যতম একটি যেখানে স্তন কর আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এই কর আরোপের আইন সবার জন্য প্রযোজ্য ছিল না। শুধু নিম্নবর্ণের মহিলাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল এই কাজে। স্তন করের উদ্দেশ্য ছিল বর্ণ কাঠামো বজায় রাখা। শুধু তাই নয়, সেকালে ওই রাজ্যে পোশাকের সামাজিক রীতিনীতি এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে করে একজন ব্যক্তির জাত বোঝা যেত তার পোশাক দেখেই। মহীয়সী নারী নাঙেলি ছিলেন এঝাভা নামক নিম্নবর্ণের নাগরিক। থিয়া, নাদর এবং দলিত সম্প্রদায়ের লোকেদের কর দিতেন তারা।
বিবিসির প্রতিবেদক নাঙেলির গ্রামে গিয়ে সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামত নিলে গ্রামবাসীরা বলেন, তিনি স্তন কর পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানান। বলা হয়ে থাকে উনবিংশ শতকের নারীদের জন্য এটি ছিল অনন্য এক সাহসী পদক্ষেপ। তবে এই গল্প নিয়ে একাধিক বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে তার মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু ২০০ বছরের অধিক সময় পরেও ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে অনেকখানি।
বিবিসির বরাত দিয়ে গ্রামবাসীরা নিশ্চিত করেছেন যে নাঙেলি অত্যধিক রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে এখানে আরও একটি আত্মত্যাগের গল্প রয়েছে। জানা যায়, যখন নাঙেলির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছিল তখন তার স্বামী জলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেন। সেদিন পর পর দুইজনের আত্মত্যাগের গল্পই জানান নাঙেলির গ্রামের বাসিন্দারা। বলা হয়ে থাকে ভারতের ইতিহাসে স্ত্রীর চিতায় স্বামীর আত্মত্যাগের প্রথম ও শেষ ঘটনা এটি। ওই দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। বর্তমানে নাঙেলির আত্মীয়রা মুলাছিপুরম থেকে আশেপাশের অঞ্চলে বসবাস করছেন।
৩৫ বছর বয়সী কৃষ্ণবর্ণের নাঙেলি প্রতিদিন কাজের জন্য বাইরে যেতেন। তিনি সবসময় নিজের স্তন ঢেকে রাখতে পছন্দ করতেন। হঠাৎ একদিন কর সংগ্রাহকদের নজরে পড়েন নাঙেলি। রাস্তা আটকানোর পরেও তিনি কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। নাঙেলি তখন তাদের বলেছিলেন, ‘আমার স্তন আমি আবৃত রাখব নাকি অনাবৃত রাখব তা ঠিক করে দেয়ার তুমি কে? আমি কর দেবো না।’
সেদিন রাস্তা থেকে কোনোমতে ছাড়া পেলেও পরদিন থেকে তার বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে কর সংগ্রাহকরা। একপর্যায়ে তাকে কর পরিশোধ করতে চাপ দিতে থাকে রাজার লোকজন। অবশেষে একদিন কর দিতে রাজী হন ওই নারী! কর সংগ্রাহকদের বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে চলে যান তিনি। তারপর ধারালো অস্ত্র দিয়া নিজের স্তন দুটি কেটে নিজের স্তনদ্বয়কে পাতার আবরণে মুড়িয়ে কর সংগ্রাহকের হাতে কর হিসেবে তুলে দেন তার রক্ত মাখা স্তন!
নাঙেলি তাদেরকে বলেন, যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত কর দিতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখবো না!’ এই কাণ্ড দেখে হতবাক হন শুল্ক সংগ্রাহকসহ পাড়া প্রতিবেশী সবাই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙেলির মৃত্যু হয়! পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা! চাপের মুখে কয়েকদিনের মধ্যেই রাজা ত্রিভাঙ্গুর স্তন করসহ সকল প্রকার অবৈধ শুল্ক বাতিল করতে বাধ্য হন!
আর নিজের অজান্তেই নাঙেলি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত কাপড় দাঙ্গা’র বীজ বপন করে যান! নিজের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পুরো কেরালার নারীদের সম্মান রক্ষা করে গেছেন বীরাঙ্গনা নাঙেলি! চাইলেই পারতেন বাকী সব নারীদের মতো অবৈধ ওই কর মেনে নিতে! শুল্ক দেয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে পৃৃথিবীর সবাই নির্যাতিত হতে জন্মায় না, কেউ কেউ নির্যাতনকারীদের থাবা থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করতেও আসেন। ভারতীয়দের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলেন নাঙেলি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ