দরপত্র অনুযায়ী, জাপান ও তাইওয়ানে উৎপাদিত ‘জাপানি মানের’ ৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কথা। কিন্তু কেনাকাটা শেষে যন্ত্রপাতি কারখানায় স্থাপন করা হয়ে গেলেও জানা যায়নি এগুলো আসলে কোন দেশে তৈরি। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি।
পাশাপাশি তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। বরং অভিযুক্ত প্রকল্প পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে।
চট্টগ্রামে অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস লিমিটেডকে শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পে এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এবং বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান।
গাজী ওয়্যারস লিমিটেড সুপার এনামেল কপার ওয়্যার উৎপাদন করে, যা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও বিভিন্ন মোটরের কয়েল তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিকীকরণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালে জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের অধীনে ২টি প্যাকেজে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯টি যন্ত্র কেনা হয়। অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ‘জাপানিজ স্ট্যান্ডার্ড’ শর্তযুক্ত ছিল।
গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে অতিরিক্ত সচিব জাফর উল্লাহকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করে শিল্প মন্ত্রণালয়। গত ৩০ মার্চ কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
কোন দেশের পণ্য!
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্রে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পায় ডায়মন্ড প্রজেক্ট কোম্পানি লিমিটেড। নির্বাচিত দরদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের দরপত্রে মেশিন তৈরির কারখানা জাপান ও তাইওয়ানে অবস্থিত এবং নয়টি মেশিনের ছয়টি তাইওয়ানের কারখানা থেকে সরবরাহ করবে বলে উল্লেখ করে। প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, কারিগরি সাব কমিটি এবং গাজী ওয়্যারসের বোর্ডের কার্যপত্রে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়নি। এটিকে পদ্ধতিগত বিচ্যুতি বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়।
কারখানায় সরেজমিন পরিদর্শনে তদন্ত দল দেখতে পায়, দরপত্রে ছয়টি মেশিন তাইওয়ান থেকে সরবরাহ করার কথা উল্লেখ থাকলেও কারখানায় নয়টি মেশিনের গায়ে জাপানি কোম্পানির স্টিকার লাগানো। কারখানার পুরোনো মেশিনগুলোর মতো এগুলোর গায়ে খোদাই করা কোম্পানির নাম পাওয়া যায়নি। ফলে যন্ত্রগুলো কোন দেশের তৈরি, তা স্পষ্ট করতে পারেনি কমিটি। যন্ত্রগুলোর প্রকৃত তৈরিস্থল সম্পর্কে জানতে অধিকতর যাচাইয়ের সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা কমিটির সদস্যদের জানান, যন্ত্র সরবরাহের প্যাকিং ও জাহাজীকরণের কাগজপত্রে কোন দেশ থেকে সরবরাহ করা হয়েছে, তার তথ্য রয়েছে। তবে কমিটির সদস্যরা প্যাকিং ও জাহাজীকরণের কাগজপত্রেও অসংগতি ও অস্পষ্টতা দেখতে পেয়েছেন। যেমন একটি প্যাকেজে পাঁচটি মেশিনেই ‘মেড ইন জাপান’ লেখা, অথচ এই পাঁচটি মেশিনই তাইওয়ান থেকে সরবরাহের কথা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে দেশের সুপার এনামেল কপার ওয়্যারের বর্তমান চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানো। ২০১৮ সালে গাজী ওয়্যারের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে চাহিদার ২০ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ করা যেত। গাজী ওয়্যারের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, প্রকল্প শেষে নতুন মেশিন বসানোর পরেও দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ২৫ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি বলছে, প্রকল্প শেষেও এমন চিত্র হতাশাজনক। নতুন ও পুরোনো যন্ত্রে উৎপাদিত পণ্যের মানও একই মনে হয়েছে কমিটির কাছে।
অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবে এবং পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী, মেশিন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিএসইসি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আবশ্যক ছিল। গাজী ওয়্যারস কর্তৃপক্ষ কোনো যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বিষয়ে কোনো অনুমোদন নেয়নি, এটি গুরুতর অনিয়ম হিসেবে তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
গাজী ওয়্যারস এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া এক অভিযোগে বলা হয়, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি মেসার্স আহসান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইদুল আহসান প্রকল্প পরিচালকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
এসব অনিয়মের জন্য কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি গোলাম কবির, প্রকল্প পরিচালক আক্তার হোসেন, উপপ্রকল্প পরিচালক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব তাজুল ইসলাম এবং গাজী ওয়্যারসের কোম্পানি সচিব ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য অলক প্রিয় বড়ুয়াকে দায়ী করে তদন্ত কমিটি। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক আক্তার হোসেন পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সরকারের আরেক লাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রে বলা ছিল তিনটি জাপান ও ছয়টি তাইওয়ানের কারখানায় উৎপাদিত যন্ত্র দেবে। প্রস্তুতকারক একই ফুরুকাওয়া বুসান। সেটাই বুঝে নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত কেনাকাটায় কোম্পানির বোর্ডের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিল্প মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিএসইসির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয়। গাজী ওয়্যারসের ছয়টি মেশিন ক্রয়ের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি। গত ২১ জুন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিএসইসিকে পুনরায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।
এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান শহীদুল হক ভূঁঞা বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য বিএসইসির আইনজীবীদের কাছে দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বিএসইসির বোর্ডের অনুমতিও লাগবে।
যন্ত্রপাতি ক্রয়ের অনিয়মে অভিযুক্তকে পদোন্নতির মাধ্যমে ‘দুর্নীতি করেও পুরস্কৃত হওয়া যায়’, এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃপক্ষের তদন্তেই প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়টি উঠে এসেছে। তারপরও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত কারা নিলেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা ব্যবস্থা কেন নিলেন না, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ