শহরে একটুখানি সবুজের ছোঁয়া পেতে অনেকেই গৃহকোণে,বারান্দায় কিংবা ছাদজুড়ে বাগান করে থাকেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণের সাথে পাল্লা দিতে এই স্বল্প পরিবসরে গাছ লাগানো কী যথেষ্ট? দিল্লির স্থপতি মানস ভাটিয়ার কাছে তা মনে হয়নি; তাই তিনি হাজির হয়েছেন ভবন নির্মাণের অবিশ্বাস্য কিছু নকশা নিয়ে, যা কখনো সাধারণ মানুষ কল্পনাই করতে পারেনি!
মানস ভাটিয়ার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে গাছপালা-শৈবাল দিয়ে আবৃত আকাশচুম্বী আবাসিক ভবন বানানোর, যেগুলো কিনা একই সাথে ‘বায়ু বিশুদ্ধকরণ টাওয়ার’ হিসেবে কাজ করবে! কিন্তু শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, মানসের এই পরিকল্পনা কী আসলেই ততটা সহজ?
নিজের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিলে কেমন দাঁড়াবে তা বোঝার জন্য ভবনের নকশা করিয়েছেন মানস এবং সেগুলোর একাধিক ছবিও প্রকাশ করেছেন। তার কল্পনার ভবনের নকশার দিকে তাকিয়ে প্রথম দেখায় রূপকথার কোনো নগরীর ছবি মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মহানগরীর বুকে জেগে ওঠা ভবনগুলোর বাঁকানো আকৃতি আসলে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত, ঠিক যেমন একটা গাছ বেড়ে ওঠে তার নিজস্ব রূপে!
নিবন্ধটি শুনুনু
কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই নকশাগুলো পুরোপুরি মানস ভাটিয়ার নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। ‘এআই x ফিউচার সিটিস’ নামক এই প্রকল্পের নকশা দাঁড় করাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটি ইমেজিং টুল ‘মিডজার্নি’ ব্যবহার করে ভবনের নকশা বের করে এনেছেন এই স্থপতি।
ধারাবাহিক লিখিত বর্ণনার সাথে মিল রেখে কাল্পনিক ছবি তৈরি করতে পারে এই টুল। মানসের লেখা ‘ভবিষ্যতের টাওয়ার’, ‘ইউটোপিয়ান প্রযুক্তি’, ‘মিথোজীবিতা’ এবং ‘বায়ো্লুমিনেসেন্ট উপাদান’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছযুক্ত বর্ণনা দেখার পর ভবনগুলোর ডিজিটাল ছবি তৈরি করেছে এই টুল।
মানস ভাটিয়া জানান, প্রতিটি পরাবাস্তব চিত্রকর্মের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন টুলটির ২০ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। ফটোশপে দিয়ে চূড়ান্ত ছবি আনার আগে, নিজের পছন্দসই ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি প্রজেক্টেই তিনি শতবার তার বর্ণণা পরিমার্জন করেছেন, সম্পাদনা করেছেন এবং নতুন শব্দ যোগ করেছেন।
তিনি বলেন, “ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ এর অংশটা সবচেয়ে মজার ছিল। আমরা ছবি তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিজেই নিজেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং নিজেকে আরও উন্নত করে তুলেছে।”
‘মিথোজীবি স্থাপত্য’ নামক ভিন্ন আরেকটি প্রকল্পে মানস এমন এক ভবিষ্যত পৃথিবীর কথা ভেবেছেন যেখানে জীবন্ত উপকরণ দিয়ে ভবন তৈরি করা হবে। ‘দৈত্যাকার’, ‘ফাঁপা’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে তিনি ছবি তৈরি করিয়েছেন। এটিকে তিনি ‘ইউটোপিয়ান ফিউচার বা কাল্পনিক ভবিষ্যৎ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, সেখানে রেডউড গাছের মতো বিশালাকৃতির গাছের ভেতরে তৈরি করা হবে অ্যাপার্টমেন্ট।
মানস ভাটিয়া জানান, ক্যালিফোর্নিয়ায় ৩৮০ ফুট লম্বা, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা গাছ ‘হাইপেরিয়ন’কে দেখে এ ধরনের নকশা তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া, ভারতীয় আর্কিটেকচার ফার্ম ‘অ্যান্ট স্টুডিও’র একজন প্রকৌশলী হিসেবে সেখানে নিজের কাজ থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন মানস।
“ভবনের মধ্যে যদি এমন ব্যবস্থা রাখা যায় যে ভবনটি নিজেই নিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তাহলে এটা দারুণ ব্যাপার হবে। ভবন নির্মাণের উপকরণ যদি অর্গানিক হয়, তাহলে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ভবনটি নিজ থেকেই সেখানে বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে পারবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন টুলগুলোর (যেমন- ওপেন এআই’র ডাল-ই ২ এবং গুগল রিসার্চের ‘ইমাজেন’) জনপ্রিয়তার কারণে সৃজনশীলতা ও সত্যিকারের শৈল্পিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত মাসে কলোরাডোর গেম ডিজাইনার জ্যাসন এম. অ্যালেন ‘মিডজার্নি’ টুল ব্যবহার করে আঁকা, রেঁনেসা ঘরানার একটি ফিউচারিস্টিক ছবি জমা দিয়ে ৩০০ ডলার পুরস্কার পান।
এরপরেই এটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অ্যালেনের ছবি আঁকার পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একাংশ। কিন্তু অ্যালেন জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন টুলের মাধ্যমে হলেও ছবিটি তৈরি করতে তার ৮০ ঘন্টা সময় লেগেছে এবং এটিকে একটি ডিজিটাল চিত্রকর্ম হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে।
তবে মানস ভাটিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্রেফ একটা টুল হিসেবেই দেখেন। তার মতে, “মানুষ চাইলে শিল্পের যেকোনো অর্থ দাঁড় করাতে পারে। একজন শিল্পী তার শিল্প তৈরি করতে যেকোনো টুল ব্যবহার করতে পারেন। যে কেউই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু তারা একজন সৃজনশীল ব্যক্তির সমপর্যায়ের কাজ দেখাতে পারবেন না।”
ব্যবহারকারীদের কল্পনারও বাইরে, এমন কিছু একটা তৈরি করার ফলে মানুষের মধ্যে নতুন ধারণা জন্ম নিতে পারে এবং ভবনের নকশার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন মানস। শুধু তাই নয়, তিনি এমন একটি ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করেন, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) থ্রিডি নকশা তৈরি করতে পারবে এবং স্থপতিরা তাদের কাজের মডেল বানাতে যেসব সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, সেগুলোর সঙ্গে একীভূত করা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে।
মানস বলেন, “এখানে একটা দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে স্থপতি ও ডিজাইনাররা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিলে ভিন্নধর্মী কাজ করতে পারবেন।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ