আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে ইপ্সিত গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে অতি সম্প্রতি।
মেক্সিকোর রিও গ্র্যান্ড নদীতে অন্তত আট অভিবাসীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দেশটির কর্মকর্তারা শুক্রবার জানিয়েছে, টেক্সাসের কাছে ঈগল পাসে কয়েক ডজন অভিবাসী একটি বিপজ্জনক পারাপারের চেষ্টা করার সময় এ ঘটনা ঘটে।
মার্কিন কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) এবং মেক্সিকান কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার নদী পার হওয়া মানুষের একটি বিশাল দলের সাথে কথা বলার সময় ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে প্রবল স্রোত থাকায় অভিবাসীদের এ অবস্থা হয়।
সিবিপির এক বিবৃতি অনুসারে, মার্কিন কর্মকর্তারা ছয়টি লাশ এবং মেক্সিকান দল অন্য দুটি লাশ উদ্ধার করে।
সিবিপি জানিয়েছে, মার্কিন কর্মকর্তারা ৩৭ জনকে উদ্ধার করে এবং ১৬ জনকে আটক করেছেন। এদিকে মেক্সিকান কর্মকর্তারা ৩৯ অভিবাসীকে হেফাজতে নিয়েছে। সীমান্তের দুই পাশের কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে যে মূল পথগুলো ধরে মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় ঢুকতে চেষ্টা করে, সেসব পথে যাত্রা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। এসব রুট যে দেশগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছে, কোভিডে কড়া বিধিনিষেধ আরোপের ফলে, সেসব বহু দেশে ঢোকা কঠিন হয়ে ওঠে। এখন আবার এসব রুটে মানব পাচার শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আগামী দিনগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম তাদের এক হিসাবে বলছে ইউরোপ ও আমেরিকার গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে ২০১৪ সাল থেকে হয় প্রাণ হারিয়েছে, নয়ত নিখোঁজ হয়ে গেছে প্রায় ৫০,০০০ অভিবাসী। সংস্থাটি মনে করে মৃত ও নিখোঁজ মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
অভিবাসীদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ কোনগুলো? এসব পথে কেন বিপদের এত ঝুঁকি রয়েছে?
ভূমধ্যসাগরকে সবচেয়ে ভয়ংকর রুটগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে আখ্যা দেয়া হলেও ইউরোপে অভিমুখে আসার পথে বেশ কয়েকটি অভিবাসন রুট রয়েছে যেগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও তেমন আলোচিত নয়। সাহারা মরুভূমি এমনই একটি অঞ্চল। এটিকে অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দিতে চাওয়া অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে বড় কবরস্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) আঞ্চলিক প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র লুসিল মারবু।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক সহ-অর্থায়িত অভিবাসীদের সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন লুসিল মারবু।
রেডক্রসের এই কর্মকর্তা জানান, অভিবাসন রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিখোঁজ হয় সমুদ্রে। তবে এর বাইরে ইউরোপীয় মহাদেশের বহিঃসীমান্তেও অভিবাসীরা নিখোঁজ হয়। বিশেষ করে যখন তারা বলকান রুটসহ বিভিন্ন স্থল সীমানা অতিক্রম করার চেষ্টা করেন। অনেক অভিবাসীরাই সীমান্তে এসে দেশে থাকা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। আবার অনেকের ফোন চুরি বা হারিয়ে যায়। অভিবাসীরা যদি তাদের আত্মীয়দের টেলিফোন নম্বর মুখস্থ না রাখে তাহলে পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে অসুবিধা হয়।
মরুভূমিতে মানুষকে দেখবেন নানা কারণে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ ওই কঠিন পথে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। দম পায় না। কারো কারো সাথে থাকা পানি ফুরিয়ে যায়।
অনেক পরিবার এভাবে মাসের পর মাস তাদের সদস্যদের কোনো খবর ছাড়াই অপেক্ষায় থাকেন। সব নিখোঁজ ব্যক্তি কিন্তু মারা যায় না। কিছু অভিবাসী বেঁচে থাকেন কিন্তু আমরা তাদের খুঁজে পাই না অথবা তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি না। একই দেশে থেকেও দুই ভাইবোন বহু বছর ধরে বিচ্ছিন্ন থাকার আশ্চর্যজনক ঘটনাও রেডক্রস দেখতে পেয়েছে। জার্মানিতে থাকা দুই অভিবাসী ভাই একে অপরের থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকেও একে অপরকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিলেন।
বহু আফ্রিকান অভিবাসীর জন্য ইউরোপের পথে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন শুরু হয় তাদের নিজেদের মহাদেশের ভেতর দিয়ে যাত্রার মাধ্যমে। তাদের গন্তব্য থাকে উত্তর আফ্রিকা আর তার জন্য পার হতে হয় সাহারার দীর্ঘ মরুপথ।
এই পথে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ। আইওএম-এর আনুমানিক হিসাব বলছে ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাহারা মরুভূমি পার হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫,৪০০ মানুষ।
অভিবাসী এবং এধরনের পথ পাড়ি দেবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন এএফপিকে বলেন, মরুভূমিতে মানুষকে দেখবেন নানা কারণে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ ওই কঠিন পথে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। দম পায় না। কারো কারো সাথে থাকা পানি ফুরিয়ে যায়।
অভিবাসীদের জন্য আরেকটা বিশাল ঝুঁকি হল ওই এলাকায় তৎপর বহু মানব পাচারকারী দল।
“চোরাকারবারী, মানব পাচারকারী এবং সীমান্ত এলাকার কর্মকর্তাদের হাতে নানাভাবে সহিংসতা ও নিগ্রহের শিকার হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সাহারা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পাচারের এই রুটে অভিবাসী মৃত্যুর বড় কারণ হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে এদের দিক থেকে আসা নানা সহিংস আচরণ,” উল্লেখ করা হয়েছে এই বিষয়ে আইওএম-এর সর্ব-সাম্প্রতিক রিপোর্টে।
বর্তমানে কতজন নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান করছে রেডক্রস? এমন প্রশ্নের জবাবে রেডক্রসসের আঞ্চলিক প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র লুসিল বলেন, ইউরোপে আসার পথে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অভিবাসীদের জন্য রেডক্রস ‘ট্রেস দ্য ফেস’ নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। এই প্ল্যাটফর্মটি একটি ডাটাবেস যা ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের শনাক্ত করতে সহায়তা করে। এটির সাহায্যে উভয়পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে।
ইউরোপের বহিঃসীমান্তে এসে অনেক পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
২০২১ সাল পর্যন্ত এই প্লাটফর্মে ১৬,৫০০ জন ব্যক্তি ২৫,৬০০ জন অভিবাসীর সন্ধানে যুক্ত হয়েছেন। ‘ট্রেস দ্য ফেস’ প্লাটফর্মের মাধ্যমে গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি পরিবার তাদের পরিবারকে খুঁজে পান।
ট্রেস দ্য ফেস’ প্লাটফর্মে নিবন্ধিতদের মধ্যে প্রচুর আফগান রয়েছে। অন্যান্য সর্বাধিক প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয়তাগুলো হল সিরীয়, ইরিত্রীয়, ইরাকি এবং সোমালি। এর বাইরে কঙ্গো এবং টিউনিশিয়ার নাগরিকরাও আছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ