ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক
আমাদের উঠতি বয়সে আমরা তুমুল উত্তেজনা নিয়ে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হই। সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন করি। ৯০ এর দশকের সেই সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় ছিলেন মিখাইল গর্ভাচেভ। আর আমাদের কাজ ছিল তাদের পাঠ মুখস্ত করা। গর্ভাচেভ সেখানে সংস্কারের আওয়াজ তুলেছেন। আমরাও সেগুলো উদয়ন-একতা ও নেতাদের কথায় সে পরিবর্তন-সংস্কারের সংবাদ গিলছি।
এরমধ্যে হাতে এলো নেভিব্লু মলাটের একটা বই “গ্লাসনস্ত ও পেরেসত্রোইক্যা” যার অর্থ হলো “খোলা হাওয়া, খোলা মন” সে বইয়ের লেখক ছিলেন, মতিউর রহমান (যদি ভুল না করি, বর্তমানে প্রথম আলোর সম্পাদক। সে সময় সিপিবি’র সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক)। আমরা সেটা পড়ে ভাল করে জানলাম এই গ্লাসনস্ত ও পেরেসত্রোইক্যার মাজেজা কি? সেটা পড়ে আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের বন্ধুদের সাথে কত তর্ক করেছি। তাদের বলেছি, গর্ভাচেভই হচ্ছে আসল কমিউনিস্ট, আসল নেতা। সে বোধ ও মোহ কাটতে বেশী সময় লাগেনি যখন সব তাসের ঘরের মত এক এক করে ভেঙ্গে গেল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নই ভাঙ্গলো না। সমগ্র পূর্ব ইউরোপের দেশও এক এক করে পুঁজিবাদের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল!
সে সময় বিশ্ব রাজনীতির যে একটা ভারসাম্য ছিল তাকেও এককেন্দ্রীক করা হলো। দেশে দেশে গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ভূমিকা ছিল তা ক্ষতিগ্রস্থ হলো। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙ্গে গেল। যে সব বড় বড় নেতা ও মস্কোপন্থী বুদ্ধিজীবীরা আমাদের গ্লাসনস্ত-পেরেসত্রোইক্যা বুঝালেন তারা সোভিয়েত ছাতা ফেলে চলে গেলেন।
সে সময় গর্ভাচেভের এই তত্ত্ব বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত একটি বিষয়। তখনই বাম বলয় তাঁর এই ভাবনাকে নিয়ে দুইভাগে ভাগ হয়ে পরলো।
এক্ষের মত ছিল, গর্বাচভ পেরেস্ত্রোইকা তত্ত্বের মাধ্যমে সোভিয়েতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করবেন। সোভিয়েত সমাজের অভাব-অভিযোগ দূর করবেন। পার্টির মধ্যে আরো গণতন্ত্র আনবেন। এতে করে সমাজতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। পিরিস্ত্রোইকার প্রধান স্লোগানই ছিল ‘আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র’। কত সুন্দর কথা!
আর ‘গ্লাসনস্ত’ মানে খোলা মন, মানে মন খুলে অবাধে কথা বলার স্বাধীনতা। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সোভিয়েত কমিউনিস্টদের বদনাম ছিল যে, সেখানে কথা বলার স্বাধীনতা নেই, সব কিছু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাই সে গ্লাসনস্ত দিয়ে তিনি সোভিয়েত জনগণকে মুক্তি দিলেন। আর তাতে সোভিয়েত সমাজে ঢেউ শুরু হয়ে গেল। বাধভাঙ্গা ঢেউ। অতীত শাসক ও অবস্থার সমালোচনা হলো। লেনিন-স্তালিন কেউ বাদ গেলেন না। তারা এতটাই স্বাধীনতা পেলেন যে, স্তালিনকে খুনী-অপরাধী বলেও সমালোচনা শুরু করলেন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে গর্ভাচেভের সেই নীতি কি কোন ষড়যন্ত্র ছিল, না সোভিয়েত পার্টির ভিতরের দূর্বলতার কারণেই ৯০এ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় হয়েছিল? এ বিষয় নিয়ে বিশ্বে এখনো বিতর্ক আছে, বিতর্ক আরো হবে। যতদিন না এ বিষয়ের কোন আসল দলিল সামনে না আসবে।
তবে শক্তিশালী মত হচ্ছে, এবং সমাজবিজ্ঞানীদের সাধারণ মত হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটা ষড়যন্ত্র যার মূলহোতা মিখাইল গর্বাচভ নিজে। তিনি মার্কিনের চর ছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি তাঁর লোকদের নিজের আসেপাশে ভিড়িয়েছেন। পশ্চিমা দালালদের সাথে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় এই অপকর্মটি করেছেন। যার পরিণতিতে অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ৮ দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৯১ সালে ধ্বংস করে পশ্চিমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টাকে স্বার্থক করেন।
গর্ভাচেভ এ কাজ ভিতর থেকে না করলে- সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে যে দূর্বলতা ছিল তাকে অস্বীকার করা সুযোগ নেই। তা থাকলেও তাকে এত সহজে ধ্বংস করা যেতো না। সেটা ভিতর থেকে কেউ না করলে। সোভিয়েতের বিপর্যয়ের পরে যে শান্তিপূর্ণ ও মদের আসরে ভাগবন্টন এবং নেতৃত্বের লুটপাট হয়েছে, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
গর্ভাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি ছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তিনি যদি কমিউনিস্টই হবেন তাহলে সেটা হবার কথা নয়। যেমন বর্তমান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একজন পুঁজিবাদী শাসক। তিনি সে দেশের নেতা হলেও পশ্চিমা বিশ্বের মহাশত্রু! আর কমিউনিস্ট গর্ভাচেভ ছিলেন তাদের জানি দস্ত, তা কিভাবে সম্ভব? তিনি তাদের কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তার একটা উদাহরণ দেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জরিপের সময় সিনিয়র বুশের স্ত্রী সংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে বলেছিলেন, আমার স্বামী জিতবেনই যদি না নির্বাচনের গর্ভাচেভ দাড়ান। তারপরেও কি বলতে হবে তিনি ছিলেন একজন সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট?
আজ বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমের প্রধান শিরোনাম সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ এর মৃত্যু। তাঁকে নিয়ে তাঁকে ঘিরে পশ্চিমা সংবাদের নানা সংবাদ-প্রতিবেদন ও আদিখ্যেতা দেখে কোন ভাবেই মনে হবে না তিনি সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের একজন প্রতিনিধি ছিলেন। আজ তাদের এক মহাশোকের দিন, কারণ তারা হারিয়েছেন তাদের এক পরম বন্ধুকে। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় গর্ভাচেভের মৃত্যু যেন তাদের কাছে আশিবাদ হয়ে এসেছে। এই সুযোগে পুতিনের রাশিয়াকে আর একটু ঝালাই, বদনাম করা যাবে। মিখাইল গর্ভাচেভের মৃত্যু বর্তমান দুনিয়ায় এক দীর্ঘশ্বাসের বিদায় বৈ অন্য কিছু নয়।
ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আপনার মতামত জানানঃ