সুনামগঞ্জের শাল্লায় ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’র ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের মামলায় কারাবরণকারী সেই ঝুমন দাসকে (২৬) ফের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফেসবুকে কথিত উসকানিমূলক পোস্ট শেয়ার দেয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার সকালে তাকে হেফাজতে নেয় শাল্লা থানা পুলিশ। প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানান, শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুমনুর রহমান মামলাটি করেন।
এ বিষয়ে ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গত রোববার বেলা ৩টার দিকে ঝুমন দাস তার ‘ঝুমন দাস আপন’ ফেসবুক আইডিতে ‘মসজিদ-মন্দির’ নিয়ে একটি ‘উসকানিমূলক’ পোস্ট করেন। ওই পোস্টের পর এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঝুমন দাসকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় পোস্টটি তার করা বলে স্বীকার করেন তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে শাল্লা থানার পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে। পরে সেই মামলায় ঝুমন দাসকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
ঝুমনের ভাই নূপুর দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার অভিযোগে পুলিশ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় তাকে থানায় নিয়ে যায়। এর আগে দুই দিন ধরে তাকে ফলো করছিল পুলিশ। তার মোবাইল পুলিশ নিয়ে গেছে এবং কিছু পোস্ট রিমুভ দিয়েছে।
‘সন্ধ্যায় ঝুমনের স্ত্রী থানায় গেলে তাকে জানানো হয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঝুমনকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু মধ্যরাতে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
‘সন্ধ্যায় ঝুমনের স্ত্রী থানায় গেলে তাকে জানানো হয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঝুমনকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু মধ্যরাতে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
ঝুমনের ফেসবুকে শেয়ার করা ছবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্দিরের ভেতরে মসজিদের দানবাক্স সংক্রান্ত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি নিজের আইডি থেকে শেয়ার করেছিলেন ঝুমন। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।’
এর আগে গত বছরের ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলন’ নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক এতে বক্তব্য দেন।
এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের ঝুমন দাস। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন।
মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচার চালাতে থাকেন তার অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
পরদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি, মন্দির। ঝুমনের স্ত্রী সুইটিকে পিটিয়ে আহত করা হয়।
এরপর ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল করিম।
শাল্লায় হামলার ঘটনায় শাল্লা থানার এসআই আব্দুল করিম, স্থানীয় হাবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ও ঝুমন দাসের মা নিভা রানী তিনটি মামলা করেন। তিন মামলায় প্রায় ৩ হাজার আসামি। পুলিশ নানা সময়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তারা সবাই এখন জামিনে।
শুধু জামিন পাচ্ছিলেন না ঝুমন দাস। বিচারিক আদালতে পাঁচ দফা তার জামিন আবেদন নাকচ করেন বিচারক। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা চলছিল।
এর মধ্যে জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন ঝুমন দাস। কারাবন্দির ছয় মাস পর শর্তসাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রদায়িকতার ছায়ায় থেকে ধর্ম অবমাননার নামে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজ স্বাভাবিক ঘটনার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। তার উপর দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতায় সরকারের সর্বশেষ বিধিনিষেধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এক আইনেই কিস্তিমাত। সরকারের সমালোচনা নেই বললেই চলে। বিতর্কিত এই আইন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে তুমুল বিতর্কিত হলেও, এর অপপ্রয়োগ রোধে কোন ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়নি বরং প্রয়োগ বেড়েছে কয়েকগুণ। শাল্লাহ’র ঝুমন দাসও এই আইন আর দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির বলি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ