‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’ জাহাজডুবির ঘটনা আজও বিভীষিকাময়। ১৯৪৫ সালে যখন সারা বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবদাহে ছারখার। এই সময়েই বাল্টিক সাগরের মাঝে যাত্রিবোঝাই জাহাজ তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের মুখে পড়ে। টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটি মাঝসমুদ্রে ডুবে যায়। সমুদ্রের বরফ পানিতে জমে মারা গিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।
প্রসঙ্গত, ১৯১২ সালে বিশ্ববাসীকে অবাক করে প্রথম যাত্রা শুরু করে ‘টাইটানিক’। তবে এটাই যে তার শেষ যাত্রা হবে তা কে জানত। হিমবাহের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে যায় জাহাজটি। এই দুর্ঘটনায় মারা যান দেড় হাজার মানুষ। তবে জাহাজডুবির এই ঘটনার তিন দশক পর বাল্টিক সাগরের বুকে আরো এক জাহাজডুবি ঘটে যা ‘টাইটানিক’-এর থেকেও ভয়ঙ্কর।
‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’। ২০৮.৫ মিটার লম্বা ও ২৩.৫৯ মিটার চওড়া এই বিশাল জাহাজটি বিলোম অ্যান্ড ভস শিপইয়ার্ডের তরফে তৈরি করা হয়েছিল। এই জাহাজটি মূলত নাৎসিদের একটি বিশেষ দলের বিনোদনের কথা ভেবে বানানো হয়েছিল। এই জাহাজটির নামকরণ হিটলারের নামে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা পরে সুইস শাখার নাৎসি দলনেতা উইলহেল্মের নামে রাখা হয়।
প্রায় ২৩ কোটি কেজি ওজনের এই জাহাজটি ১৯৩৮ সালে যাত্রা শুরু করে। ৪০০ জন ক্রু সদস্য-সহ এই জাহাজটির মোট এক হাজার ৯০০ যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল।
প্রথমে ক্রুজ জাহাজ হিসেবে এই জাহাজটি ব্যবহার করা হত। নাৎসি দলের সদস্যদের মধ্যে কেউ কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে এই ক্রুজটি সেজে উঠত। শুধু তাই নয়, ১৯৩৮ সালের ১০ এপ্রিল এই জাহাজটি ভোটকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
অস্ট্রিয়ার সংযোজন নিয়ে ইংল্যান্ডের জার্মান এবং অস্ট্রীয় নাগরিকেরা এই জাহাজেই ভোট দিতে এসেছিলেন। পরে জার্মান সেনাবাহিনীর পরিবহণকারী জাহাজ হিসেবে ব্যবহৃত হত ‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নরওয়ে এবং বাল্টিক সাগরে এই জাহাজটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছিল।
১৯৪০ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই জাহাজটি পোল্যান্ডে ঠাঁই নিয়েছিল। দ্বিতীয় ডুবোজাহাজ প্রশিক্ষণ ডিভিশনের সেনাছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল এই জাহাজ। পরিস্থিতি অনুযায়ী, বার বার নিজের ভূমিকা বদলেছিল এই সুবিশাল জাহাজ। ১৯৪৫ সালে এক ভয়ানক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় ‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’।
বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তখন নিজের নাম লিখতে শুরু করেছে ‘অপারেশন হ্যানিবল’। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ভয়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে অনেকে তখন একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বন্দরে জাহাজের সারি। যাত্রীদের ভিড় উপচে পড়ছে। সেই সময় আবার নিজের ভূমিকা বদলে যাত্রিবাহী জাহাজে পরিণত হয় উইলহেল্ম।
ঘোষণা করা হয়, যাত্রীদের নিয়ে রওনা হবে বলে ২৫ জানুয়ারি এই জাহাজটি বন্দরে এসেছে। প্রচারের চার দিনের মধ্যেই দেখা যায়, সাত হাজার ৯৫৬ জন যাত্রী নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। যে জাহাজটি দুই হাজার যাত্রী বহনে সক্ষম, তাতে ওঠার টিকিট কেটেছিলেন তার প্রায় চার গুণ মানুষ!
৩০ জানুয়ারি দুপুরবেলা আনুমানিক ১০ হাজার যাত্রী নিয়ে জার্মানির ক্রিয়েগসমেরিন বেসের অন্তর্গত কিয়েলের উদ্দেশে রওনা হয়। জাহাজের প্রতিরক্ষার জন্য দুইটি টর্পেডো বোট এবং আরো একটি ছোট জাহাজ যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই ছোট জাহাজে সেনাবাহিনীর লোকজন থাকবে বলে ঠিক করা হয়।
তবে সেই ছোট জাহাজটিতে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। এ ছাড়াও একটি টর্পেডো বোটকে কোনো কারণে ফিরে যেতে হয়। অবশেষে একটি টর্পেডো বোট নিয়েই রওনা হয় ‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’। দুপুর পেরিয়ে যতো অন্ধকার বাড়তে থাকে, জাহাজের ক্যাপ্টেনের চিন্তাও বাড়তে থাকে পাছে শত্রু আক্রমণ করে।
ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক পিটারসন নির্দেশ দেন, মাঝ সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে যেতে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা থাকলেও সোভিয়েত আক্রমণের হাত থেকে বাঁচা যাবে। জাহাজে যে সেনা কম্যান্ডার ছিলেন, তিনি ক্যাপ্টেনের এই নির্দেশে রাজি হননি।
তার মত ছিল, জাহাজের সব আলো নিভিয়ে সৈকত বরাবর যাওয়া উচিত যাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকেও বাঁচা যায় এবং শত্রুপক্ষও জাহাজের উপস্থিতি টের না পায়। দুইজনের বাকবিতণ্ডা চলাকালীন পিটারসনকে জানানো হয়, জার্মানির একটি বিস্ফোরক অনুসন্ধানকারী জাহাজ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
জাহাজের আলো না জ্বালালে দুই জাহাজের সংঘর্ষে ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারে। বিপদ থেকে বাঁচতে আলো জ্বালানোর নির্দেশ দেন পিটারসন। এই নির্দেশে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন পিটারসন। দূর থেকে যাকে জার্মানের বিস্ফোরক অনুসন্ধানকারী জাহাজ ভেবে আলো জ্বালানো হয়েছিল তা আসলে ছিল রাশিয়ান এস-১৩ সাবমেরিন। আলো জ্বালিয়ে শত্রুপক্ষের হাতে নিজে থেকেই ধরা দেয় ‘উইলহেল্ম গাস্টলফ’।
সাবমেরিন থেকে পর পর তিনটি টর্পেডো জাহাজের দিকে ছোড়া হয়। তিনটির মধ্যে একটি জাহাজের নীচের দিকে কেবিনে, একটি সুইমিং পুল এলাকায় এবং শেষ টর্পেডোটি জাহাজের ইঞ্জিনে এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের আলো নিজে থেকেই নিভে যায়। যাত্রীদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়।
প্রাণ বাঁচানোর জন্য সবাই ছোটাছুটি আরম্ভ করেন। অনেকে সেই ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান। তবে যাত্রীরা তাদের উপর দিয়েই দৌড়ে যান। পদপিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান অনেকে। সংঘর্ষের ফলে জাহাজটি এক দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই সেদিকে বাঁধা একটিও লাইফবোট পানিতে নামানোর মতো অবস্থায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত নয়টি লাইফবোট পানিতে নামানো হলে তাতে ওঠার জন্য যাত্রীরা নিজেদের মধ্যেমারপিট শুরু করে দেন।
অনেকে আবার পানিতে ঝাঁপ দেন সাঁতার কেটে নিজের প্রাণ বাঁচাবেন বলে। তখন জানুয়ারি মাসের কনকনে ঠাণ্ডা। বাল্টিক সাগরের পানির তাপমাত্রা -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। বরফ পানিতে ঝাঁপ দিতেই ঠাণ্ডায় জমে মারা যান অনেকে। লাইফবোটে উঠবেন বলে অনেকে আবার লাইফবোটগুলোকে ঘেরাও করে ফেলেন।
লাইফবোটের উপর থাকা যাত্রীদের পানিতে ফেলে তারা নিজেরা নৌকায় উঠবেন বলে একে অপরকে ধাক্কা দিতে শুরু করেন। প্রাণ বাঁচাতে দাঁড় দিয়ে মেরে তাদের সরিয়ে দেন লাইফবোটের যাত্রীরা। এর ফলে অনেকেই ডুবে মারা যান। এই ঘটনার প্রায় ৪৫ মিনিট পর যাত্রীদের উদ্ধার করতে কয়েকটি জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছয়। তবে পৌঁছনোর পর যে বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ে তা দেখে সবাই আঁতকে ওঠেন। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ-সহ সমুদ্রে ভেসে রয়েছে সারি সারি মৃতদেহ।
১০ হাজার যাত্রীর মধ্যে মাত্র এক হাজার ২০০ জনকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করার সময় তাদের নজরে পড়ে একটি ছোট বাচ্চালাইফবোটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে সেই উদ্ধারকারী দলের এক আধিকারিক তাকে দত্তক নেন।
জাহাজের মোট নারী যাত্রীর মধ্যে মাত্র তিন জন বেঁচে ছিলেন। যারা বেঁচেছিলেন তাদের মধ্যে এক জন জানান, জাহাজে এক উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক সপরিবারে যাত্রা করছিলেন। ঠাণ্ডা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে জমে মারা যাওয়া অনেক বেশি কষ্টকর, তাই নিজের দুই সন্তান-সহ স্ত্রীকে গুলি করে মেরে আত্মঘাতী হন।
পরে তদন্ত করে জানা যায়, সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন মারিনেস্কো মত্ত অবস্থায় কাজ করতেন। এই জন্য তার সম্মানহানিও হয়েছিল। তাই নিজের হারানো সম্মান ফিরে পেতে তিনি জাহাজ আক্রমণের নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন, শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেছেন বলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কোনো পুরস্কার তিনি পাননি। তবে তার এই সিদ্ধান্ত যে কতটা মর্মান্তিক, তার ভয়াবহতা এখনও ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ