বাংলাদেশে গণপরিবহনে যাতায়াত করা ৯৪% নারীই মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ফলে গণপরিবহনে চলাফেরা করা নারীদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে অল্প বয়সী তরুণীরা যৌন হয়রানির সমস্যায় বেশি ভোগেন।
প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। যেমন নগরে নারীর একা চলাচলে নিরাপত্তার অভাব। যানবাহনে চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অনিশ্চয়তা নারীর স্বাধীন চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া অন্যান্য গণপরিবহনেও যাতায়াতকালে নারীরা অসম্মানজনক আচরণেরও শিকার হচ্ছেন। শুধু পরিবহনশ্রমিক, চালক, সহকারী নন, কখনো কখনো পুরুষযাত্রী দ্বারাও এ ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীদের।
রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যেমন অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, তেমনি অনেককে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বের অভিশাপ। সড়কে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ঘটে চলেছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হলেও গণপরিবহনে নারীর নিপীড়িত-নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি খুব কমই গুরুত্ব পাচ্ছে। নারী অধিকারকর্মীদের ভাষ্য, সড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কমাতে নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন দাবি-পরামর্শ উপস্থাপিত হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গণপরিবহনে চলাফেরায় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি।
নারীবান্ধব যানবাহন না থাকাই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বড় কারণ। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীবান্ধব যানবাহন, চালক ও সহকারী থাকতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে যাত্রীদের মানসিকতায়ও।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সড়কে নারীর নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষিত চালকের অভাব একটি বড় সমস্যা। নারীবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা গড়তে ও পেশাগত নারী গাড়িচালক তৈরির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি নারী গাড়িচালক প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে।
বাস, লঞ্চ বা ট্রেনের মতো গণপরিবহন ও টার্মিনালে নারীরা সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হন। অনেক নারী একাধিকবার নিগ্রহের শিকার হন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী বেশি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং আওয়ামী লীগের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) এক যৌথ জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশের ৮ বিভাগের ২৪ জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। ই-মেইল, ফেসবুক ও মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে জরিপ চালানো হয়। এতে ৫ হাজার ১৮৭ তরুণী ও নারী অংশ নেন।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ ও ৩৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৮ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর, ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ইউএনডিপির হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ বীথিকা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দুটি উদ্দেশ্যে এই জরিপ। প্রথমত, জনপরিসরে নারী নিগ্রহের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, নারী ও তরুণীদের ৬৬ শতাংশ বলেন, তাঁরা একাধিকবার নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। প্রায় নিয়মিত নিগ্রহের শিকার হন, এমন নারী ৭ শতাংশ।
নিগ্রহের নানা ধরন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪২ শতাংশ ইভ টিজিংয়ের শিকার হন। এর মধ্যে আছে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, শিস দেওয়া বা শরীরের সংবেদনশীল অংশে হাত দেওয়া। অশোভন আচরণের শিকার হন ১৫ শতাংশ নারী।
এর মধ্যে আছে অশ্লীলতা প্রদর্শন ও অনাকাঙ্ক্ষিত চাহনি। ১২ শতাংশ নারী প্রকাশ্যে শারীরিক স্পর্শের শিকার হন। নিগ্রহের শিকার হলেও এর ধরন বলতে রাজি হননি ১৫ শতাংশ নারী।
৩৬ শতাংশ নারী বাস, রেল, লঞ্চসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে নিগ্রহের শিকার হন। ৫৭ শতাংশ নারী মনে করেন, তাঁদের জন্য গণপরিবহন সবচেয়ে অনিরাপদ। সড়কেও নিগ্রহের শিকার হন ২৩ শতাংশ নারী। অন্যান্য জায়গার মধ্যে আছে দোকান বা শপিং মল, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম বা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বিকেলে সবচেয়ে বেশি ২৩ শতাংশ নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। নিগ্রহের ঘটনা ঘটার পর কী করেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ৩৫ শতাংশ বলেন, তারা প্রতিবাদ করেন। ৩৪ শতাংশ কোনো প্রতিবাদ করেননি। মাত্র ১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা ৯৯৯–এ ফোন করেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর হারও ১ শতাংশ।
সিআরআইয়ের সহকারী সমন্বয়ক ইশরাত ফারজানা বলেন, ‘জরিপে আমরা নারীদের নিগ্রহসংক্রান্ত অনুধাবনের বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছি। সুরক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের মতের প্রতিফলনও উঠে এসেছে জরিপে।’
জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ নারী মনে করেন, নারীর প্রতি সম্মানের অভাবে নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। ৬৪ শতাংশ নারী মনে করেন, এসব ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত। তাঁরা মনে করেন, নিগ্রহ বন্ধে সঠিক পারিবারিক শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য জেসমিন আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। আমরা আইনের একটি খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০২
আপনার মতামত জানানঃ