যতই দিন যাচ্ছে, সমাজে ধর্ষণ-গণধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ-গণধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এর থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। সরকারি হিসাবেও বেড়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন। চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। এর ফলে দেশের সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না নারী অবমাননা।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৫২৩টি।
ধর্ষণের উদ্বেগজনক এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার দেশে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হচ্ছে। ২৭ বছর আগে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালন শুরু করেন নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
১৯৯৫ সালের এ দিনে (২৪ আগস্ট) ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়িতে যাওয়ার পথে কিশোরী ইয়াসমিন (১৩) পুলিশের হাতে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যার বিচারের দাবিতে দিনাজপুরসহ সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ২০০৪ সালে ঘটনায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর ধর্ষণের মামলা ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১০ হাজার ৪০৮টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০২০ সালে প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৪৯ শতাংশ মামলা ছিল ধর্ষণের। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে এই হার ৪৮ শতাংশ।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে সরকার। তবে এখনো এই আইনের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি কল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪, যৌন নির্যাতন ২৬৮, ধর্ষণের হুমকি ৩১ এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগে ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫ এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি কল আসে।
অবশ্য ৯৯৯-এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, কলের সংখ্যা বাড়ার মানে এই হারে নির্যাতন বেড়েছে তা নয়। ৯৯৯ নম্বরে কল করলে প্রতিকার পাওয়া যায় বলে কল বেড়েছে।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে সরকার। তবে এখনো এই আইনের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে সেখানে ১৪২টি মামলা আছে। এর মধ্যে দুটি দলবদ্ধসহ মোট ধর্ষণের মামলা ৬৩টি। অর্থাৎ মোট মামলার ৪৪ শতাংশ ধর্ষণের মামলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সমাজে হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ করা সহজ কাজ নয়। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি- যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
তারা বলেন, কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। কূপমন্ডূকতা যেমন আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে, তেমনি নারীর ক্ষেত্রেও যেন সমাজ দিন দিন আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে নারী। কোনোভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হতে থাকবে, নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হবে- এটা যেখানে সমর্থনযোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র উদ্বেগজনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১০৫৮
আপনার মতামত জানানঃ