প্রকৃত নাম লীলাবতি। ইতিহাসে অমর হয়েছেন ‘খনা নামে’। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, খনা নামটি পরিচিত হয় জিহ্বা কাটার জন্যই। খনা অর্থ বোবা। লীলাবতির জিহ্বা কাটার পর খনা নামে পরিচিতি পায়। অনুমান করা হয় ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনো একসময়ে তার জীবনকাল ব্যাপ্ত ছিল।
বিক্রমপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহপুত্র মিহিরের সঙ্গে খনার বিবাহ হয়েছিল। কথিত আছে বরাহ তার পুত্রের জন্মকোষ্ঠী গণনা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশুপুত্র মিহিরকে একটি পাত্রে করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহলদেশে পৌঁছলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালন পালন করেন এবং কন্যা লীলাবতির সঙ্গে বিবাহ দেন।
লীলাবতি তথা খনা ছিলেন একজন বিদুষী নারী। কখন কোন কাজ করলে ভালো হবে, কোন মাসে কোন ফসলের বীজ বপন করলে উত্তম হবে, কোন পরিস্থিতিতে ঝড়, তুফান, বন্যা হবে এসব বিষয়ে বাস্তবসম্মত উপদেশ দিতে পারতেন। তার নামে এখন ছড়া-বচন প্রচলিত আছে গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে মুখে।
জ্ঞান তার করুণ পরিনতির কারণ হয়েছিল। বিদুষী এ নারীর জিহ্বা কেটে নিয়েছিলেন তার স্বামী ও শ্বশুর। খনার শ্বশুর বরাহ প্রথম যখন জানতে পারেন বৌমাও জ্যোতিষ চর্চা করেন। জেনে খুশি হয়েছিলেন কিন্তু খনার সঙ্গে কথা বলে তার সেই ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কেমন ধারার সব কথা বার্তা বলে খনা! সে বলে, মানুষের আগাম ভবিষ্যৎ নাকি বুঝতে পারে— কাক, শকুন, পিঁপড়া ইত্যাদি নানান পশু পাখির দল! বরাহের মনে হয়, এ আবার কেমন ধারার কথা। এখানেই কথা শেষ নয়, বিক্রমাদিত্যের মৃগয়া নিয়েও সে বিভিন্ন কথা বলে। যেমন, শিকারের নামে পশু পাখি মেরে ফেলা নাকি একদম উচিত হচ্ছে না আমাদের। পশু পাখিরা অবলুপ্ত হলে নাকি এই পৃথিবী গ্রহটাই শেষ হয়ে যাবে।
একদিন দুপুর বেলা কড়া রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়েছেন বরাহ। একটু শান্তি করে ঘুমাবেন বলে বিছানায় পা তুলেছেন, এমন সময় রাজবাড়ি থেকে লোক হাজির হল। রাজা বিক্রমাদিত্যের আদেশ, এখনই হাজির হতে হবে তাকে। অগত্যা বাধ্য হয়ে সেজে গুজে রথের ওপর চড়ে বসলেন। এমন সময় খনা এসে বলল, একটু পরে ঝড় বৃষ্টি থামলে তার পর বেরোন বাবা! খনার কথায় চমকে উঠছিলেন বরাহ। এ আবার কেমন ধারার কথা!
বরাহ খানিক বিরক্ত হয়েই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খনার দিকে। তারপর খানিক ধীর স্বরেই বললেন, এ ধরনের রসিকতার কারণ কী? এই আচরণ তার থেকে একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। খানিক চুপ থেকে খনা বলল, বাবা পিঁপড়েদের চলাচল দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, খানিক পরেই উত্তাল ঝড় উঠবে। এ বার খানিক রাগ করেই বরাহ চিৎকার করে বললেন, এসব অসভ্যতা তুমি তোমার জঙ্গলে রেখো এসো। সিংহল দেশের মেয়ের থেকে আর কীই বা প্রত্যাশা করতে পারি আমি। সরে যাও পথ থেকে।
খনা সরে দাঁড়াল। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে খনার স্বামী মিহির সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না। এই বিক্রমাদিত্যের দেশে এসে একটু বেকায়দাতেই পড়েছে খনা। এখানে নিয়ম-কানুন সব যেমন কেমন অন্য ধারার। এখানে বাড়ির কর্তার মুখের ওপর কেউ কথা বলে না। ঠিক-ভুলের বিচারক এক এবং একমাত্র বরাহ। খনা মাঝে মাঝে ভাবে, মিহির তো তার সঙ্গে বড় হয়েছে। তারা এক নদীতে শ্যাওলার স্রোত পেরিয়ে মাছ ধরেছে। প্রবল ঝড়ে পাখিদের বাসা আর ডিম বাঁচিয়েছে। রক্তাক্ত সাপের শুশ্রূষা করেছে। মিহিরও বোঝে, সন্ধ্যার পর কেমন করে পাখিরা কথা বলে। কিন্তু তার পরেও মিহির বদলে গেছে। মিহির এখন পিতার সঙ্গে নানান আঁক কষে, পুঁথি পড়ে। খানিকটা পথ পেরিয়ে আসার পর বরাহ হাড়েহাড়ে টের পেল, খনার কথা কতখানি সত্যি! দিনের আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে। ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে।
পথের মধ্যে একটি অতিথিশালা দেখতে পেলেন বরাহ। প্রকৃতির এই অশান্ত রূপ দেখতেই ভালোবাসে খনা। সিংহল দেশে তো এমন ঝড়ের রাতেই কতবার অভিসারে বেরিয়েছে খনা এবং মিহির। অবশেষে বেশ কিছুটা সময়ের পর সিক্ত বসনেই বরাহ হাজির হলেন বিক্রমাদিত্যের দরবারে। বরাহ বুঝতে পারছেন না যে হঠাৎ করে কেন সম্রাট তাকে তলব করেছেন। সম্রাটকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হল বরাহর। বরাহ বিক্রমাদিত্যের প্রশস্তি জানিয়ে বিনীত ভাবে বললেন, সম্রাট আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? খানিক চুপ থেকে বিক্রমাদিত্য বললেন, হে মহান জ্যোতিষাচার্য, আপনি কি উদ্ধার করতে পেরেছেন, কেন আমাদের সামান্ত রাজ্যে অনাবৃষ্টি চলছে দীর্ঘদিন ধরে?
মহারাজের প্রশ্ন শুনে লজ্জিত হলেন বরাহ। অনেক দিন ধরেই তিনি আঁক কষে চলেছেন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কোনো হদিস করতে পারছেন না বরাহ। কোথাও যেন একটা কিছু ভুল রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ভুলটা যে ঠিক কী, সেটা উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বরাহকে নীরব দেখে সমস্ত ব্যপারটা অনুধাবন করতে পারলেন বিক্রমাদিত্য।অনেকটা ধীর স্বরে বরাহ বললেন, আর কয়েকটা দিন সময় দিন সম্রাট। একটা উত্তর ঠিক খুঁজে বের করব আমি। খানিক বিচলিত স্বরে বলে উঠলেন বিক্রমাদিত্য, সেই সময়টুকুই তো আজ নেই আচার্য্য।
মতবাদ আছে, ঐ সমস্যার সমাধান করে দেন খনা। সমাধান করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাজার। খনা এবং মিহির দু’জনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করায় একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। একদিন পিতা বরাহ ও পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে খনা এ সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খনার গণনা করে দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতেন বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে নবরত্নের ‘দশম রত্ন’ হিসেবে আখ্যা দেন। রাজ্যে কোনো সমস্যা হলে রাজা বিক্রমাদিত্যই লোক পাঠিয়ে ডেকে আনতেন খনাকে। মিহির ও বরাহের তুলনায় খনার গ্রহণযোগ্যতা রাজা স্বয়ং এবং সাধারণ প্রজার কাছে অনেক বেশি ছিল। খনার শ্বশুর বরাহ সভার পদ হারানোর ভয় পেয়ে যান। একপর্যায়ে সম্ভবত খনার সঙ্গে তর্কও করেন। একজন নারীর সঙ্গে তর্কে না পেরে এবং রাজ সভাসদের পদ হারানোর ভয়ে পুত্রকে আদেশ দেন জিহ্বা কেটে দেওয়ার জন্য। যেন আর কোনোদিন কথা বলতে না পারে খনা।
জিহ্বা কেটে নেয়ার আগে শান্ত অথচ কান্না ভেজা গলায় মিহির বলেছিল, সে নাকি তার পিতার আদেশে এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আজ সে নিরুপায়। এই পাপ তার হৃদয়কে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। বরাহের আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। প্রচুর রক্তপাতের ফলে কিছু সময় পরই খনার মৃত্যু হয়।
আপনার মতামত জানানঃ