দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমতে শুরু করলেও, এটি শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। করোনার আগে এক জন শিক্ষার্থী স্কুল, বাসা এবং প্রাইভেট শিক্ষক সব মিলিয়ে ছয় ঘণ্টা পড়াশোনার কাজে ব্যয় করত। কিন্তু দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় গড়ে এক জন শিক্ষার্থী দুই ঘণ্টা করে পড়ালেখায় ব্যয় করেছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি তাদের মানও কমে গেছে। শিশুদের পড়া, লেখা, অঙ্ক করার মতো বিষয়গুলোতে দক্ষতাও কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
ইউনিসেফের সহায়তায় করা ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেনস এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে এ চিত্র উঠে এসেছে। শিগ্গিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, সঠিকভাবে পড়তে পারা, সাধারণ যোগ-বিয়োগ করার মতো বিষয়গুলো ২০১৯ সালে সঠিকভাবে করতে পারত ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। করোনার পরে ২০২১ সালে এই হার ২৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসে। তাছাড়া সঠিকভাবে বানান করে পড়তে পারে—এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগেও দেশে কম ছিল। ঝরে পড়ার হারও করোনা কালে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ১৮ মাস টানা বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের সেপ্টেমবর থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দূরশিক্ষণ, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়াও রেডিও টিভির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এরকম পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। বিশেষ করে দুর্গম ও গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের অবস্হা জানতে আটটি বিভাগে ৯ হাজার পরিবারে এই জরিপ পরিচালনা করে বিসিএস।
এ প্রসঙ্গে বিবিএসের ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের পরিচালক মো. মাসুদ আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মূলত করোনার প্রকোপে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল সে সময়ের অবস্হা জানতে এ জরিপটি করা হয়েছে।’
সঠিকভাবে পড়তে পারা, সাধারণ যোগ-বিয়োগ করার মতো বিষয়গুলো ২০১৯ সালে সঠিকভাবে করতে পারত ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। করোনার পরে ২০২১ সালে এই হার ২৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসে। তাছাড়া সঠিকভাবে বানান করে পড়তে পারে—এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগেও দেশে কম ছিল।
বৈশ্বিকভাবে পড়াশোনায় ব্যাঘাতের অর্থ হলো লাখ লাখ শিশু শ্রেণিকক্ষে থাকলে যে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারত, তা থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বঞ্চিত হওয়া। সেসব শিশুদের জন্য এই একাডেমিক শিক্ষা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যারা চরাঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে এবং উপজাতি।
এসব শিশুদের বেড়ে ওঠা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অনেক বেশি অনুকূল হয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন করোনা মহামারির ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সব শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাতের পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। একইভাবে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
২০২১ সালের ১৯ অক্টোবরে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো প্রকাশিত এশিয়ায় শিক্ষা খাতের ওপর ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও মোকাবিলা কার্যক্রমবিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ (সিটএন রিপোর্ট) শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়ার প্রায় ৮০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে।
এছাড়া ২০২১ সালের আগস্টে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয় করোনাকালে লম্বা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মহামারি ভাইরাসের প্রভাবে স্কুল বন্ধের বিরূপ অবস্থা মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, রেডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষার সূচনা করেছিল। তবে সকল শিক্ষার্থীদের এ প্ল্যাটফরমগুলোতে অ্যাক্সেস না থাকায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্ল্যাটফরমে তাদের অ্যাক্সেস কম ছিল।
জরিপ করা স্কুলশিশুদের মধ্যে পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সি যথাক্রমে ৫০ শতাংশেরও কম রেডিও, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনে অ্যাক্সেস পেয়েছে। তাদের প্রায় সবারই মোবাইল ফোনে অ্যাক্সেস রয়েছে, তবে অনেকেরই ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস নেই। এ সমীক্ষায় ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজনও পাওয়া গেছে
বিশ্বব্যাংকের আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, প্রাক-করোনা মহামারি সময়ে পাঁচ বছর বয়সী বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ ন্যূনতম পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না বলে অনুমান করা হয়েছে; অথচ মহামারিকালে স্কুল বন্ধের সময় এ সংখ্যাটি ৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স-২০২০ এর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে একটি শিশু প্রাক-মহামারিকালে চার বছর বয়সে স্কুল পড়া শুরু করে সর্বোচ্চ ১৮ বছরের মধ্যে স্কুলজীবন শেষ করে থাকে। কিন্তু এ মহামারিকালে শিশুদের স্কুল শুরু করতে হচ্ছে প্রায় ৫-৬ বছর বয়স থেকে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে শুরুতেই দু-এক বছরে চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরোদমে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাই ইতোপূর্বে মহামারি চলাকালীন শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, অসম শিখন সমস্যা, বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, মূলত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বারবার হোঁচট খায় সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এবং যুগোপযোগী ধারণার প্রয়োগের অভাবে। এ ধারায় মুক্তচিন্তার বিশেষজ্ঞ কম পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে আপসহীন প্রয়োগের জন্য বিশ্বমানের পরিকল্পনা প্রস্তুত থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সর্বোপরি, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর তা খুলে দেয়াতেই শিক্ষার গতি বৃদ্ধি কিংবা মানোন্নয়ন নিশ্চিত হয়ে যায় না বরং শিক্ষায় বিশাল আকারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। এটা সত্য যে, করোনার কারণে শিক্ষার ছত্রছায়া থেকে অনেক শিক্ষার্থী দূরে সরে গেছে।
তাদের আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। করোনার কারণে শিক্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষাই পারে একটি দেশ ও জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে নিয়ে যেতে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন দুর্বল অবস্থায় ফেলে রাখলে চলবে না বরং পদক্ষেপ গ্রহণে এখনই আরও বেশি দৃঢ়চেতা হওয়া জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৭
আপনার মতামত জানানঃ