বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে একলাফে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার৷ তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম গত সপ্তাহে একশো ডলারের নীচে নেমে এসেছে৷
বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম রাতারাতি ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা করা হয়েছে৷ পেট্রোলের দাম ৫১ দশমিক এক ছয় শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ১৩০ টাকা হয়েছে৷ অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১ দশমিক ছয়-আট শতাংশ৷ প্রতি লিটারে যার দাম পড়বে ১৩৫ টাকা৷ এর আগে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম একবারে কখনোই এতটা বাড়ানো হয়নি৷
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের লোকসান কমানো ও পাচার ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাস, ট্রাক, ভ্যানের ভাড়ায়৷ লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে৷ সবমিলিয়ে পরোক্ষ প্রভাব পড়তে চলেছে একাধিক খাতে৷ যে সব পণ্য পরিবহণের মাধ্যমে বাজারে আসে, সেগুলিরও দাম বাড়বে৷ ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরো বাড়বে৷
পরিবহন ভাড়া বাড়ছে
ডিজেলের দাম বাড়ানোর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে সড়কে। ঢাকার সড়কে গণপরিবহন কমে যাওয়ায় ছুটির দিনেও বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। দূর পাল্লার গাড়ি চলাচলও কমে গেছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাসভাড়া কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ২৯ পয়সা এবং লঞ্চ ভাড়া ৪২ পয়সা বাড়তে পারে বলে ধারণা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। শনিবার এ বিষয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দূরপাল্লার বাসে বর্তমানে (৫২ আসনের) প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা। ডিজেলের দাম বাড়ানোয় ২৯ পয়সা বেড়ে এ ভাড়া হবে ২ টাকার মতো। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়বে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
শহর এলাকায় (৫২ আসনের) বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এখন ২ টাকা ১৫ পয়সা। এটি ২৮ পয়সা বেড়ে ২ টাকা ৪৩ পয়সার মতো হবে। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাড়বে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এ ছাড়া লঞ্চে বর্তমানে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ২ টাকা ১৯ পয়সা। ৪২ পয়সা বেড়ে এ ভাড়া হবে ২ টাকা ৬২ পয়সা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়বে ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ।
দৃশ্যত জ্বালানি তেলের সঙ্গে বাসের ভাড়াও বাড়াতে চাইছেন পরিবহন মালিকরা। কেবল জ্বালানির দাম বৃদ্ধিই নয়, যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে চিঠি দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা।
কর্মকর্তা ও পরিবহন নেতারা জানান, গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের ৬টি আইটেম ২০২০ সালের তুলনায় গড়ে ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গতকাল ঘোষিত জ্বালানির দাম ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মোট ৭০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আজ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে এ সকল বিষয় বিবেচনা করে দ্রুত বাস ভাড়া পুনঃ-নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাস, ট্রাক, ভ্যানের ভাড়ায়৷ লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে৷ সবমিলিয়ে পরোক্ষ প্রভাব পড়তে চলেছে একাধিক খাতে৷ যে সব পণ্য পরিবহণের মাধ্যমে বাজারে আসে, সেগুলিরও দাম বাড়বে৷ ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরো বাড়বে৷
আপনারা কি বাস ভাড়া ৭০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি করছেন জানতে চাইলে এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরেছি। এখন ভাড়া নির্ধারণ কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
তিনি আজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া বাড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট করিনি।’
গত বছরের নভেম্বরে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর কর্তৃপক্ষ বাস ভাড়া ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল।
চিঠিতে, পরিবহন মালিকদের সংগঠন ২০২০ এবং ২০২২ সালে টায়ার, লুব্রিকেন্ট এবং ফিল্টারসহ ৬টি খুচরা যন্ত্রাংশের বৃদ্ধির মধ্যে তুলনা করেছে।
তবে কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত বিষয়গুলো সমন্বয় করে ২০২১ সালের নভেম্বরে বাস ভাড়া বাড়ায়।
বাড়ছে দুর্ভোগ
শুক্রবার রাতে হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমন দুর্ভোগে পড়েছে রাজধানীর মানুষ। শনিবার সকাল থেকে রাজধানীতে আগের মতো বাসের দেখা মিলছে না। দীর্ঘ সময় পর পর দু-একটি বাস এলেও তাতে উঠতে পারছে না যাত্রীরা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রাজধানীর কর্মজীবী মানুষ।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে পূর্বঘোষণা ছাড়াই গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছেন বাসমালিকেরা। সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়েও গণপরিবহনে উঠতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করছে সাধারণ যাত্রীরা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে মনে করছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, পরিবহন ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাবে। পরিবহন খাতে অস্থিরতা দেখা দেবে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে শনিবার (৬ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমের কাছে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছির বাড়ানোর ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক ছোট ছোট শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে একদিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতি ওপর চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে বেকারত্ব সমস্যা আরও প্রকট হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত তেলের দাম যে পরিমাণ বাড়ে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বাড়ে বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ভাড়া। পণ্য পরিবহন ভাড়াও ইচ্ছেমত বাড়িয়ে দেয় ট্রাক-কভার্ডভ্যান মালিকেরা।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা একচেটিয়াভাবে ভাড়া যে পরিমাণ বাড়ায় গণপরিবহনের তার কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে। সরকার নির্ধারিত ভাড়া গণপরিবহনে আদায় হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা বা বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
এদিকে শনিবার এক বিবৃতিতে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সংগঠনটি বলছে, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। অনতিবিলম্বে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে, পূর্বের মূল্য বহাল করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয় ৮০ টাকা লিটার। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ যা তেলের দাম বাড়ানো হারের চেয়ে অনেক বেশি।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বিশ্ববাজারে বর্তমানে তেলের বাজার নিম্নমুখী। এই সময়ে বাজার পর্যবেক্ষণ না করে, কেবল আইএমএফের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। অনতিবিলম্বে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে, পূর্বের মূল্য বহাল রাখার দাবি জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩২
আপনার মতামত জানানঃ