ছাত্রলীগ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন ও লাঞ্ছিতের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক নির্যাতনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কর্মরত এক সাংবাদিককে মধ্যরাতে আবাসিক হলের অতিথিকক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী মারধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার(২ আগস্ট) দিবাগত রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে এ ঘটনা ঘটে।
মারধরের শিকার ওই সাংবাদিকের নাম আল আমিন হোসাইন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী (৪৯তম ব্যাচ)। তিনি একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগের কর্মীরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসাদ হক ও আরিফ জামান, রসায়ন বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের জাহিদ হাসান, ৪৭তম ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের জিয়াদ মির্জা, দর্শন বিভাগের মীর হাসিবুল হাসান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের রাইহান বিন হাবিব ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মুনতাসির আহমেদ তাহরীম এবং আইন ও বিচার বিভাগের মাসুম বিল্লাহ।
তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। মারধরের শিকার ও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা সবাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক ছাত্র।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সংবাদমাধ্যমকে জানান, রুম থেকে ডেকে এনে নিজের ও বন্ধুদের পরিচয় দিতে বলা হয় ওই সাংবাদিককে। পরিচয় পর্ব শেষে রুমের সিলিং ধরে নির্দিষ্ট সময় ঝুলে থাকতে বলা হয় তাকে। বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার আগেই ওই সাংবাদিক নেমে গেলে ক্ষুব্ধ হয়ে টেবিলের নিচে মাথা দিতে বলা হয় তাকে। কিন্তু, এতেও তিনি অপারগ হলে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় নির্যাতনকারীরা।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক হল প্রভোস্ট বরাবর ‘শারীরিক নির্যাতন ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের’ বিচার চেয়ে আবেদন করেছেন।
আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টায় হল ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আমাকে জোরপূর্বক হলের গেস্টরুমে ডাকে। আমি অস্বীকৃতি জানালে তারা আমার কক্ষে লোক পাঠিয়ে জোড়পূর্বক গেস্টরুমে নিয়ে যায়। সেখানে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। একপর্যায়ে গেস্টরুমের সিলিংয়ে আমাকে ঝুলতে বাধ্য করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিছুক্ষণ ঝুলার পর পড়ে যাই। তখন আসাদ হক (নৃবিজ্ঞান-৪৬), আরিফ জামান সেজান (নৃবিজ্ঞান-৪৬), হাসিবুল হাসান রেশাদ (দর্শন-৪৭) ও মাসুম বিল্লাহ (আইন ও বিচার-৪৭) আমাকে মারার জন্য তেড়ে আসে। এরপর আসাদ গেস্টরুমে থাকা কফি টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে কান ধরে থাকতে বলে। আমার শারীরিক অসুস্থতার (কোমরে ফোড়া) কারণে মাথা ঢোকাতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা আবারও মারমুখী ভঙ্গিতে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘একপর্যায়ে আসাদ আমাকে সাংবাদিকতা পেশা ও বিভাগ নিয়ে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ কথা শোনায় এবং ১০ মিনিট লাফাতে বলে। লাফাতে দেরি করলে রুমে অবস্থানরত ২৫-৩০ জন ছাত্রলীগকর্মীর সবাই আমাকে মারতে উদ্যত হয়। তখন আমি লাফাতে শুরু করি এবং একপর্যায়ে ৫ মিনিটের মতো লাফানোর পর থেমে যাই। তখন তারা আবারও তেড়ে আসলে আমি আবারও লাফাতে শুরু করি। লাফানো থেমে যাওয়ার পর আসাদ হক (নৃবিজ্ঞান-৪৬), আরিফ জামান সেজান (নৃবিজ্ঞান-৪৬), রায়হান বিন হাবিব (নৃবিজ্ঞান-৪৭), জিয়াদ মির্জা (অর্থনীতি-৪৭), হাসিবুল হাসান রেশাদ (দর্শন-৪৭) মুনতাসির আহমেদ তাহরিন (প্রাণিবিদ্যা-৪৭), মাসুম বিল্লাহ (আইন ও বিচার-৪৭), জাহিদ (রসায়ন-৪৮) আমাকে মোবাইল বের করতে বলে। আমি মোবাইল দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা মোবাইল কেড়ে নেয়। মোবাইলের লক খুলে দেওয়ার জন্য জোরজবরদস্তি শুরু করে।’
রুম থেকে ডেকে এনে নিজের ও বন্ধুদের পরিচয় দিতে বলা হয় ওই সাংবাদিককে। পরিচয় পর্ব শেষে রুমের সিলিং ধরে নির্দিষ্ট সময় ঝুলে থাকতে বলা হয় তাকে। বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হওয়ার আগেই ওই সাংবাদিক নেমে গেলে ক্ষুব্ধ হয়ে টেবিলের নিচে মাথা দিতে বলা হয় তাকে। কিন্তু, এতেও তিনি অপারগ হলে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় নির্যাতনকারীরা।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক বলেন, ‘লক খুলে না দিলে একপর্যায়ে আসাদ, রায়হান, সেজান, জিয়াদ, রেশাদ, মুনতাসির, মাসুম বিল্লাহ, জাহিদ, ইমরান আহমেদ (বাংলা-৪৮), শাহাদাৎ (প্রত্নতত্ত্ব-৪৮), নাফিস ইকবাল (ইতিহাস-৪৮) আমার শার্টের কলার ধরে এলোপাতাড়িভাবে মারতে শুরু করে। এরপর তারা আমাকে জোরপূর্বক তিন তলার (আব্দুল্লাহ আল আকাশ, নৃবিজ্ঞান-৪৪ এর রুম) দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকেরা আসলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু তখনো তারা আমার মোবাইল ফেরত দেয়নি। দুই ঘণ্টা পর ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আসার ১০ মিনিট আগে তারা মোবাইল ফোনটি ফেরত দেয়।’
শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অভিযুক্ত আসাদ হক, আরিফ জামান সেজান এবং জাহিদ হাসান ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতির ঘটনা বর্ণনা করেন এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু সিলিংয়ে ঝোলানো এবং মারধর বিষয়টি অস্বীকার করেন তারা।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আজ থেকে ওই কর্মীরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকুক, তারা সেটা চান না। এখন থেকে তারা সাংগঠনিক কাজকর্মে অবাঞ্ছিত বলে গণ্য হবেন। বর্তমান কমিটি থাকা অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে তারা যুক্ত থাকবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে হল প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে।’
এদিকে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নিকট আহ্বান জানিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবাদপত্রকে বলা হয় একটা দেশের দর্পণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংবাদপত্র চেক এন্ড ব্যালেন্সের কাজ করে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের সংবিধানে ব্যাপারে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাজোট সরকার আসার পর বিভিন্ন সময় এরা সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছিলো এসব ব্যাপারে বেপরোয়া। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করায় বা করার জন্য সংবাদ সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেই ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে তারা সাংবাদিকদের মারধর, লাঞ্চিত, ক্যামেরা ভাংচুর, এমন কি হত্যাও করেছে।
সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। যদি সংবাদপত্র তাদের কাজ ঠিকমত চালাতে না পারে তাহলে কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই পৃথিবীর বুকে মাথা উচু দাঁড়ানো সম্ভব না। এভাবে সংবাদকর্মী ও সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত মানেই হচ্ছে দেশের অগ্রযাত্রাকে স্তিমিত করে দেয়া।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৪
আপনার মতামত জানানঃ