সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। যখন–তখন রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।
সর্বশেষ রবিবার (৩১ জুলাই) সকালে ওই এলাকায় মো. ইলিয়াছ ও সৈয়দ আহমদ নামে স্থানীয় দুই জনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এর আগের দিন নোয়াখালীপাড়ার মোহাম্মদ মুবিনুল ও মোহাম্মদ নূর নামে আরও দুই জনকে অপহরণের পর ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ মুক্তিপণ দাবি করে স্বজনদের কাছে। তবে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপহৃতরা কেউ উদ্ধার হয়নি।
টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে পুলিশি তৎপরতা বাড়ায় ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ স্থানীয় বিভিন্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গম ওই পাহাড়ি এলাকা থেকে তারা অপরাধমূল কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাদক চোরাচালানসহ স্থানীয় এবং রোহিঙ্গাদের অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব অপরাধীরা। গত দুই দিনে বাহারছড়া এলাকা থেকে স্থানীয় চার জন অপহরণ হয়েছেন। আর এক মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০ জন। এসব ঘটনায় এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় পাঁচ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি আরসার (আগের নাম আল-ইয়াকিন) নাম ব্যবহার করে অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, আরসার অস্তিত্ব নেই। অনেক সময় সাধারণ রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
জানা যায়, টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। গত এক মাসে বাহারছড়া এলাকায় সাত-আটটি অপহরণের ঘটনা ঘটে। প্রায় ১০ জন স্থানীয় লোক অপহরণের শিকার হন। তবে সব ঘটনার বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ পৌঁছেনি। স্থানীয়রা মুক্তিপণ দিয়ে স্বজনদের মুক্ত করেন।
এপিবিএন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের সাত মাসে রোহিঙ্গা শিবিরসহ টেকনাফের বাহারছড়া এলাকায় অর্ধশতাধিকের মতো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ অপহৃতকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর আটটি মামলায় ১০ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এর মধ্য বাহারছাড়া এলাকায় গত এক মাসে আটটির মতো অপহরণের ঘটনায় পাঁচ জন অপহরণকারী গ্রেপ্তার হয়েছে।
গত দুই দিনে বাহারছড়া এলাকা থেকে স্থানীয় চার জন অপহরণ হয়েছেন। আর এক মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০ জন। এসব ঘটনায় এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় পাঁচ গ্রামের ২০ হাজার মানুষ।
তবে এসব ঘটনার অধিকাংশ মাদকের লেনদেনের কারণে ঘটছে বলে দাবি করেছেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাহারছড়ায় অপহৃতদের উদ্ধারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তবে মাদক লেনদেনের কারণে ওই এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় স্থানীয়রা নিজেই এসব সমস্যার সমাধান করেন। যে সব ঘটনা পুলিশের কাছে আসে না।’
এপিবিএন-১৬-এর অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় সাত মাসে ৩০টি অপহরণের ঘটনায় দুই জন বাংলাদেশিসহ ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় পাঁচটি মামলায় সাত অপহরণকারীকে গ্রেফতারও করা হয়। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বেশির ভাগ অপহরণ মাদকের কারণে ঘটেছে।’
উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন, যার সদস্যসংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। জেলা পুলিশের তথ্যমতে, এ দেশে আসার পর পৌনে পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৪ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ২ হাজার ৪০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৫ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৭৬টি ও ১৮৮ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা হয়েছে ২৫টি। পৌনে ৫ বছরে আশ্রয়শিবিরে খুনের মামলা হয়েছে ৭৪টি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৯ রোহিঙ্গাকে। একটি ঘটনায় সর্বোচ্চ ছয়জন রোহিঙ্গা খুনের নজিরও আছে।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫-২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। এখানে প্রতিদিন প্রায় শত কোটি টাকার ইয়াবা-আইস ও সোনা চোরাচালানের লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই হয়।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে তৈরি করেছে অপরাধী গ্রুপ। তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এতে প্রায়ই খুন, সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটছে অপহরণের মতো ঘটনাও। এ ছাড়া ধর্ষণ, ডাকাতির ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবার আখড়ায় পরিণত করেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টেও পরিণত হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
স্থানীয় জনগণ তো বটেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত স্বীকার করা হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করছে, নারী ও শিশু পাচার, মাদক পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে, এমনকি তারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও প্রায় পাঁচ বছর আগের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের বক্তব্য অস্বাভাবিক নয়। মূলত অতীতে রোহিঙ্গাবিষয়ক সিদ্ধান্ত, দূরদর্শিতার বদলে নীতিনির্ধারকদের একপেশে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিল, সে প্রশ্ন চলে আসে। এ প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, কেন আজ রোহিঙ্গাদের বোঝা মনে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ