মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থি চারজন কর্মীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সামরিক জান্তা। কথিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সেনা কর্তৃপক্ষ। কয়েক দশক পর এ প্রথম এক সঙ্গে চার রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ ঘটনায় ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ভয়েস অব মিয়ানমার গত সোমবার জানিয়েছে, জান্তা সরকারের মুখপাত্র জাও মিন তুন ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।
রয়টার্স জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিলিশিয়াদের সাহায্য করার অভিযোগে চারজন গণতন্ত্রপন্থি কর্মীকে গত জানুয়ারি মাসে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এর আগে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে একটি সামরিক আদালতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ধারণা করছে, সামরিক আদালতে একইভাবে আরো ১০০ জনেরও বেশি রাজনৈতিক কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় শোষণের নির্মম উস্কানি’ বলে বর্ণনা করেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে যে, মিয়ানমারে সামরিক আদালতের দণ্ড মাথায় নিয়ে আরও প্রায় ১০০ জন মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের দাতা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম জাপান এ ঘটনায় ‘গভীরভাবে শোক’ প্রকাশ করেছে।
এএফপি জানায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রু বলেছেন, তিনি এ খবর শুনে ‘মর্মাহত ও বিধ্বস্ত’ হয়েছেন। তিনি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেন।
আমি হতাশ। সারাবিশ্ব থেকে আবেদন করা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করেই এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
চারজনের মধ্যে রয়েছেন- জনপ্রিয় আন্দোলনকর্মী খাও মিন ইউ (কো জিমি নামেও পরিচিত) এবং সু চির দলের সাবেক সংসদ সদস্য ফিও জিয়া থাও। তাদের আগেই রুদ্ধদ্বার সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, গত শনিবার গোপনে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাদের চারজনকেই রাখা হয়েছিল মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের শহরতলির ইনসেইন কারাগারে। ওই কারাগারের কর্মকর্তারা চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। তারা জানান, প্রত্যেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দু’জন ছাড়া আরও যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তারা হলেন- ইউ হল্যা মিয়ো এবং ইউ অঙ থুরা ঝাও। পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে জানানো হয়নি। তারা গতকাল সকালে কারাগারে যান এবং মরদেহগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এদিকে মিয়ানমারের চার গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলকর্মী এবং নির্বাচিত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
সোমবার সংস্থাটির মানবাধিকার প্রধান বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চার গণতন্ত্রকর্মীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাশলে বলেন, আমি হতাশ। সারাবিশ্ব থেকে আবেদন করা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করেই এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
তিনি বলেন, এই নিষ্ঠুর এবং পশ্চাদপসরণমূলক পদক্ষেপ দেশটির জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর চলমান দমনমূলক অভিযানের একটি সম্প্রসারণ।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে সামরিক বাহিনী। রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা মনে করেন, ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভয় দেখাতেই এ চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ ঘটনায় মিয়ানমারে ক্ষোভ বিরাজ করছে। দেশটির দ্য ইরাওয়াদ্দি অনলাইনের প্রতিবেদনে দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের মানুষ এ ঘটনায় শোকাহত ও ক্ষুব্ধ।
প্রতিবেদনে এ চার গণতন্ত্রী কর্মীকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আন্দোলনকর্মী কো জিমি তার জীবনের অর্ধেকই (২১ বছর) বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে কাটিয়েছিলেন। আর সাবেক হিপ হপ স্টার ফিও জিয়া থাও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এনএলডির আইনপ্রণেতা ছিলেন।
গত জানুয়ারিতে ফিও জিয়া থাওকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছরের নভেম্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সরকারি বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলার পরিকল্পনা করার অভিযোগ আনা হয় ফিও জিয়া থাওর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে ইয়াঙ্গুনে একটি কমিউটার ট্রেনে বন্দুক হামলার ঘটনাও আছে। ওই হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য নিহত হন।
গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকর্মী কো জিমিওকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে একই সাজা দেওয়া হয়। অন্য দু’জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ইয়াঙ্গুনে এক নারীকে হত্যার দায়ে। ওই নারী জান্তা সরকারের তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতেন। সামরিক অভ্যুত্থানের পর অং সান সু চিকেও আটক করা হয়। এর পরই দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সামরিক সরকার প্রায় ১২ হাজার গণতন্ত্রপন্থিকে আটক করে। সু চির বিরুদ্ধে অর্ধডজন মামলায় বিচার চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় তার ১১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। গত মাসে সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে নেপিদোর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচও (এইচআরডব্লিউ) মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠনটি এ ঘটনাকে ‘সম্পূর্ণ নৃশংস কর্মকাণ্ড’ বলে বর্ণনা করেছে। রয়টার্স জানায়, জান্তাকে যে এ অপরাধকর্মের মূল্য চুকাতে হবে, তা তাদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায় এইচআরডব্লিউ।
অবশ্য মিয়ানমারে এর আগেও ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে মিয়ানমারে শেষবার বিচারিক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
গত বছরের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। সেনাবাহিনী শহরগুলোতে বেশিরভাগ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে দমন করার পর দেশজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
এএপিপি বলছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ২ হাজার ১০০-র বেশি লোক নিহত হয়েছেন। অবশ্য দেশটির জান্তার দাবি, প্রাণহানির এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত।
অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ