দেশে বছরে ১৪ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে, যা এ দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। ‘বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে গতকাল সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের এক যৌথ বিবৃতিতে এই তথ্য তুলে ধরা হয়।
এদিকে চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীতে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় জানানো হয়- গত দুই বছরে (২০২০ ও ২০২১) ১ হাজার ৪২৬টি ঘটনায় পানিতে ডুবে সারাদেশে ২,১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ১,৭৯৯ জনই শিশু।
এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ সংস্থাটি।
বিশ্বে ‘পানিতে ডুবে যাওয়া’কে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডোবা প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করে।
বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, প্রতি বছর পানিতে ডুবে বিশ্বব্যাপী মারা যায় ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। যার প্রতি ১০টি ঘটনার ৯টিই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। এসব দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
সংস্থাটি জানায়, প্রতি বছর বন্যায় বাংলাদেশের একটি বড় অংশ একটি অংশ তলিয়ে যায়। যার ফলে সচেতনতা ও সাঁতারে দক্ষতার অভাব জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। গ্রামীণ এলাকার জলাশয়ের আশপাশে বেড়ে ওঠা শিশুরাও প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, “বাংলাদেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে এত মানুষের প্রাণহানি হৃদয়বিদারক। এ মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং প্রতিটি শিশুর ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাই।”
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) প্রতিনিধি ডা. বারদান জং রানা বলেন, ‘পানিতে ডুবা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ এবং বিশ্বব্যাপী দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণগুলোর একটি পানিতে ডুবে যাওয়া। ডব্লিউএইচও ডুবে যাওয়া রোধে বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপ সুপারিশ করে এবং একটি মাল্টি সেক্টরাল উদ্যোগের প্রচার করে যাচ্ছে। মাল্টি সেক্টরাল সহযোগিতা বৃদ্ধি, ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে, আমরা এই ট্র্যাজেডি রোধ করতে পারি। সবার জন্য একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ অর্জন করতে পারি।’
তথ্য-প্রমাণ বলে, খুব সহজেই পানিতে ডুবে যাওয়া রোধ করা যায়। পরিবার ও কমিউনিটির মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তোলা, প্রাক-স্কুলের শিশুদের জন্য শিশু যত্ন কেন্দ্রের সুবিধা নিশ্চিত করা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।
সারাবিশ্বে পানিতে ডুবে যাওয়াকে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই যে প্রতিরোধযোগ্য তা তুলে ধরতে ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তুলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।
ইউনিসেফ জানায়, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বাড়ানো, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তোলা, প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুর জন্য শিশুযত্ন কেন্দ্রের সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সহজেই পানিতে ডুবে যাওয়া রোধ সম্ভব।
এদিকে, পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে ২০১৬ সালের পর জাতীয়ভাবে আর কোনো জরিপ পরিচালিত হয় নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে বেরিয়ে এসেছিল যে, প্রতি বছর দেশে সব বয়সী প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায় যাদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে তা বছরে প্রায় ১০ হাজার অথবা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন।
অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার পর পানিতে ডুবে যাওয়া হচ্ছে দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে শিশুদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হলো পানিতে ডুবে যাওয়া। এটা প্রতি বছর ১৭ হাজার মৃত্যুর কারণ।
সেন্টারের পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, ২০১৬ সাল থেকে শিশুদের ডুবে যাওয়া রোধে আমরা তেমন কিছুই করিনি। জলাশয়ের চারপাশে বেড়া দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, এটি শিশুদের ডুবে যাওয়ার ঘটনা কমাতে খুব সাহায্য করবে। সারা দেশে জীবন রক্ষাকারী কৌশল শেখানোর কর্মসূচিও চালু করতে হবে।
ভুক্তভোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসতে সময়ের অপচয়ে অনেকে মারা যান বলেও মনে করেন আমিনুর- “আমি এটা লক্ষ্য করেছি যে ডুবে যাওয়ার শিকার বেশিরভাগ মানুষকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে মৃত অবস্থায় আনা হয়। কারণ রোগীদের নিয়ে আসতে যাতায়াতে কয়েক ঘন্টা সময় লেগে যায়। যদি উদ্ধারের পরপরই ভুক্তভোগীদের কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) দেওয়া যেত, তাহলে অনেকগুলো প্রাণ বাঁচানো যেত”।
উল্লেখ্য, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও কৃত্রিমভাবে তা কিছু সময় চালিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ করাকে সিপিআর বলা হয়।
এসডব্লিউউ/এসএস/০৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ