চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে দুর্বৃত্তরা। একইসঙ্গে নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে তারা। গত রবিবার রাতে চবি ক্যাম্পাসে বোটানিক্যাল গার্ডেনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় চবি ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে লিখিত অভিযোগ দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের বিরুদ্ধে।
গত সোমবার ওই শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ নিয়ে প্রক্টরের কার্যালয়ে গেলে রুবেল তাকে বাধা দেন। এ কারণে তিনি সেদিন অভিযোগ জমা দিতে পারেননি। তিনি পরদিন প্রক্টরকে অভিযোগ দেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে লিখিত অভিযোগ দিতে সহায়তাকারী আরেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা যখন লিখিত অভিযোগ দিতে যাই তখন ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল প্রক্টর অফিসে এসে অভিযোগ দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনি তাদের চেনেন এবং বিষয়টি সমাধান করে দেবেন।’
সেই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বিভিন্নভাবে সেই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ওপর চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। রুবেল এটাও বলেন যে, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে ডেকে তিনি নাকি চড়-থাপ্পড় মেরে সমাধান করে দেবেন।’
গত রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ওই শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন করেন ৫ যুবক। ওই শিক্ষার্থী ও তার বন্ধুদের অভিযোগ, নিপীড়নকারীরা ওই শিক্ষার্থীকে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় তুলে নিয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
ওই ছাত্রীর এক সহপাঠী জানান, গত রবিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল সংলগ্ন এলাকায় ৫ জন দুর্বৃত্তের হাতে শারীরিক হেনস্তার শিকার হন ছাত্রীটি। ওই সময় তার সাথে থাকা তার বন্ধু বাধা দিলে তাকেসহ ওই ছাত্রীকে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনও ছিনতাই করে নিয়ে যায়। পরে ভুক্তভোগীদেরকে ওই জায়গা থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ছাত্রীকে ধর্ষণ করারও চেষ্টা করে তারা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রীর মধ্যে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং ভয় ছড়িয়ে পড়েছে।
আমরা যখন লিখিত অভিযোগ দিতে যাই তখন ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল প্রক্টর অফিসে এসে অভিযোগ দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনি তাদের চেনেন এবং বিষয়টি সমাধান করে দেবেন।’
বুধবার বিকেলে হাটহাজারী মডেল থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী মামলা করেন।
ওই ঘটনার পর মঙ্গলবার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে চবি ছাত্রলীগ সভাপতিকে ৩ দিনের মধ্যে দর্শানোর নোটিশ দেন।
এদিকে তিন দিন আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের রাত ১০টার মধ্যে হলে ফেরার সময়সীমা বেঁধে দেয়।
এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ দেখা দেয়। বুধবার দিনে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত না করে উল্টো ছাত্রীদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে রাতে প্রীতিলতা হলের একদল ছাত্রী উপাচার্য শিরীণ আখতারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রাত পৌনে ১০টার দিকে ৩০–৩৫ জন ছাত্রী উপাচার্যের বাসভবনের দিকে যাত্রা করলে প্রক্টোরিয়াল বডির সদস্যরা এসে তাঁদের পথ আটকান। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ ছাত্রীরা ওই হলের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা অবিলম্বে প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেন। পরে হল থেকে বেরিয়ে অপর ছাত্রীরা বিক্ষোভে যোগ দেন। রাত ১১টার পর ছাত্রীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। শতাধিক ছাত্রী সেখানে বিক্ষোভে অংশ নেন।
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নে জড়িতদের শাস্তি, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। একপর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান ঘটনাস্থলে এসে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি লিখিতভাবে চার কার্যদিবসের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত, আর তা না করতে পারলে পদত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর রাত ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে হলে ফিরে যান ছাত্রীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ। একটা ঘটনারও বিচার হয়নি। নিপীড়নবিরোধী একটা সেল রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ওই সেল তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই সেলকে পুরোপুরি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ছাত্রীরা সেলে অভিযোগ নিয়ে গেলে, অভিযোগ কমিটির কর্তাব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে অভিযোগটি গুরুত্ব দেন না। অভিযোগ আমলে নিলেও দিনের পর দিন প্রতিবেদন ফেলে রাখা হয়। সেলে যারা আছেন, তারা সুনির্দিষ্ট ওই ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের চটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হতে চান না। এ কারণে প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। কারণ, ক্যাম্পাসের ভেতর ছাত্রীদের সঙ্গে ঘটা বেশির ভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই জড়িত থাকার খবর আমরা সবাই জানি।
তারা বলেন, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন। এ কর্তাব্যক্তিরা লাভের স্বার্থটাই বেশি খোঁজেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কাছে নতজানু হয়ে থাকেন। তাই ওই ছাত্রসংগঠনের কেউ আক্রান্ত হলে তাদের রক্ষা করার জন্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ কারণে নেতা-কর্মীদের বেলায় এক ধরনের সক্রিয়তা, অন্য শিক্ষার্থীদের বেলায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে কর্তৃপক্ষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ