নিয়োগের নীতিমালা পরিবর্তন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ভিসির মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিয়ে বেকায়দায় পড়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে অসহযোগিতা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারীকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় পরিবর্তন আনার অভিযোগ পাওয়ায় উপ-উপাচার্যসহ সাত শিক্ষকের কাছে কৈফিয়ত চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একের পর এক চিঠি যায় উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার বিধি পরিবর্তন করে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের মেয়ে ও জামাতাকে দেওয়া নিয়োগ কেন অবৈধ ও বাতিল হবে না তা জানতে চায় মন্ত্রণালয়। আর এই তদন্ত চলাকালেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িঘড়ি করে বেশ কিছু নিয়োগের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নিয়োগ কেনও বাতিল হবে না জানতে চেয়ে চিঠি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন এমন অভিযোগ ওঠার পর ইউজিসি এই বিষয়ে তদন্ত করে। ওই তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে ইউজিসি। কেনও এই নিয়োগ বাতিল হবে না তা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, উপযুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নীতিমালা ২০১৫ শিথিল করে পরিবর্তিত নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান তাঁর মেয়ে জনাব সানজানা সোবহানকে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং জামাতা জনাব এ টি এ সাহেদ পারভেজ কে ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্যের এরূপ স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং গবেষণার মানও নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় উক্ত নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না তার ব্যাখ্যা আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে তথ্য-উপাত্তসহ ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেন আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের একাংশ। যার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। তদন্ত কার্যক্রম শেষে কয়েকটি সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি। ওই প্রতিবেদনে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাবিতে সকল প্রকার নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশও দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষক নিয়োগে জড়িত থাকায় উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার কাছে চিঠি। একই চিঠি পেয়েছেন ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ছয় শিক্ষক-কর্মকর্তা। তারা হলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারী, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম মুজিবুর রহমান, আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হান্নান, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গাজী তৈহিদুর রহমান, আইন বিভাগের শিক্ষক শিবলী ইসলাম এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাখাওয়াত হোসেন টুটুল।
এদের মধ্যে ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাখাওয়াত হোসেন টুটুল ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গাজী তৈহিদুর রহমান যথাক্রমে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো.জাকারিয়ার সম্পর্কে ভাগ্নে। শিবলি ইসলাম হচ্ছেন সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ও সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস’র বোনের ছেলে। অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস বর্তমান প্রশাসন দায়িত্বগ্রহণের পর প্রথম দিকে ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এম মুজিবুর রহমান আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সদস্য। এছাড়া জামায়াতপন্থী শিক্ষক আব্দুল হান্নান আইন বিভাগের সভাপতি।
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি দিতে চিঠি
রাবিতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও এর বিধি সংশোধন নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হওয়ায় তদন্তে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তবে সেই তদন্তদলকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ উঠেছ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারীর বিরুদ্ধে। তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সদস্য হিসেবে কৈফিয়তের চিঠি তো পেয়েছেনই একইসঙ্গে তাকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ ক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ
এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়েছে রাবি প্রশাসন বরাবর। সেই চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই চিঠিতে কোনও কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে ১০ ডিসেম্বর এই চিঠি হাতে পেয়েও গত ১২ তারিখে সিন্ডিকেট করে নতুন আরও কিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং ১৩ তারিখে উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানপত্র গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসডব্লিউ/নাসি/০৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ