স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা। ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্য আমদানিও। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তীব্র জ্বালানি সংকটে গণপরিবহন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কা শাটডাউনের সম্মুখীন হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ওয়েরাসিংহে।
তিনি বলেন, শিগগিরই স্থিতিশীল সরকার গঠন না হলে পুরো শ্রীলঙ্কা শাটডাউন তথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শাটডাউনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া। কোনো রাষ্ট্র শাটডাউনের অর্থ ওই দেশের সরকারি কর্মকাণ্ডে অচলাচস্থা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো অভিধানে শাটডাউন মানে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ জরুরি সেবা (ওষুধ, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম) ছাড়া অফিস-আদালত, বাজারঘাট, গণপরিবহনসহ সব বন্ধ হয়ে যাওয়া। আবার কোথাও কোথাও শাটডাউন মানে স্থবিরতাও বোঝানো হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় চলমান আর্থিক ও জ্বালানি সংকট কাটাতে প্রয়োজনীয় পেট্রোলিয়ামের জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ‘অনেক অনিশ্চয়তা’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। কারণ আন্তর্জাতিক বেলআউট প্যাকেজ পাওয়ার বিষয়ে অগ্রগতিও একটি স্থিতিশীল প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে।
নন্দলাল ওয়েরাসিংহে বলছেন, ‘আমরা সম্ভবত চলতি মাসের শেষ অবধি ডিজেলের অন্তত তিনটি চালান এবং পেট্রোলের একটি বা দু’টি চালানের জন্য অর্থায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এর বাইরেও, দেশের জন্য অপরিহার্য পেট্রোলিয়াম অর্থায়নের জন্য আমরা পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করতে সক্ষম হবো কি না তা নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে।’
শাটডাউনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া। কোনো রাষ্ট্র শাটডাউনের অর্থ ওই দেশের সরকারি কর্মকাণ্ডে অচলাচস্থা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো অভিধানে শাটডাউন মানে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া।
তিনি বলেন, ‘যদি তা না হয়, তাহলে পুরো দেশ বন্ধ (শাটডাউন) হয়ে যাবে। তাই আমাদের এমন একজন প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদ দরকার, যারা (প্রয়োজনীয় সকল) সিদ্ধান্ত নিতে পারেন… আর এটি ছাড়া, সকল মানুষ কষ্ট পেতেই থাকবে।’
অবশ্য স্থিতিশীল সরকার পেলে শ্রীলঙ্কা খুব শিগগিরই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে বলেও আশাবাদী নন্দলাল ওয়েরাসিংহে। তিনি বলছেন, একবার একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, শ্রীলঙ্কা এই সংকট থেকে ‘তিন বা চার বা পাঁচ মাসের মধ্যে’ বেরিয়ে আসতে পারে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারি, জাতীয় অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের অদক্ষতা, বিশ্বজুড়ে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জ্বালানি, খাবার এবং ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা। ডিজেলের সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারছে না শ্রীলঙ্কার বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রগুলো। ফলে গত কয়েক মাস ধরে সেখানে দিনের বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুত্ থাকছে না।
ফলে নজিরবিহীন এই সংকটের জন্য রাজাপাকসে পরিবারসহ দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারকে দায়ী করে শ্রীলঙ্কায় গণআন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করেছে। আন্দোলনের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এমনকি রাজাপাকসে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সরকার থেকে সরে এসেছিলেন।
বাকি ছিলেন কেবল দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। বুধবার তার পদত্যাগের কথা থাকলেও দিনের আলো ফোটার আগেই সামরিক বিমানে করে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পাড়ি জমান তিনি।
দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ইস্তফা দেননি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তবে তিনি দেশ ছাড়ার পরই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন সংসদের স্পিকার। এমন অবস্থায় দেশটি সাংবিধানিক সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনরোষ এড়াতে বুধবার ভোরে কলম্বো ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান গোতাবায়া রাজাপাকসে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের ‘অবস্থান’ এবং ‘গন্তব্য’ সম্পর্কে মলদ্বীপ সরকার বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও তথ্য দেয়নি। স্পিকার য়ুপা অবেবর্ধনে দুপুরে জানিয়েছিলেন যে, বুধবারই ইস্তফা দিতে পারেন গোতাবায়া। এমনকি, ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথাও ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইস্তফার খবর মেলেনি। রাজনৈতিক সংকটের এই আবহে বুধবার শ্রীলঙ্কা সেনা এবং পুলিশের তরফ থেকে স্পিকারের কাছে অশান্তি থামাতে সব দলের বৈঠক ডাকার আবেদন জানানো হয়েছে।
গোতাবায়া দেশ ছাড়ার পরে বুধবার প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রেমাসিংহে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেও ইতিমধ্যেই বিক্ষোভকারীদের নিশানা হয়েছেন তিনি। তার সরকারি দফতর তথা বাসভবনেও বুধবার বিকেলে হামলা হয়েছে।
তবে গোতাবায়ার দল শ্রীলঙ্কা পড়ুজানা পার্টি (এসএলপিপি)-র একটি সূত্র জানাচ্ছে, সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করতে পারেন তিনি।
শ্রীলঙ্কায় এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর দেশটি এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি। এ কারণে জাতিসংঘও এ দ্বীপ দেশটির জন্য সহায়তা চেয়েছে। শ্রীলঙ্কার দু’কোটি ২০ লাখ লোকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা লোকদের খাওয়ানোর জন্য ৪৭ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে এ বৈশ্বিক সংস্থাটি।
জ্বালানির তীব্র সংকটে জনজীবন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। জাতিসংঘের মতে, প্রায় ১.৭ মিলিয়ন শ্রীলঙ্কানের জন্য জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রয়োজন। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্টবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে।
এদিকে, সৌদি আরবের একটি বিমানে করে মালদ্বীপ ছেড়েছেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। তিনি প্রথমে সিঙ্গাপুর এবং পরে সৌদি আরবের জেদ্দায় যাবেন। গতকাল মালদ্বীপ সরকারের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে নিজের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মালদ্বীপের ওই কর্মকর্তা। এর আগে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে মালদ্বীপ ছাড়ার কথা থাকলেও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে তাতে যাননি তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৭
আপনার মতামত জানানঃ